আলমগীর কবিরের ১৯৭১ : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
বছরদুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাশের—নীলখেতের—পুরানা বইয়ের দোকান হইতে একটি নাতিপুরানা বই কিনিয়াছিলাম। বইয়ের নাম ‘দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ : ১৯৭১’। লেখক আলমগীর কবির। আলমগীর কবিরকে এই লেখার পাঠিকাসাধারণের মত আমিও জানিতাম চলচ্চিত্রকার পরিচয়ে। তাঁহার বানান ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’ এবং ‘মোহনা’—এই চারিটি ছবি আপনাদের অনেকের মত আমিও একদা দেখিয়াছিলাম। সে অনেকদিন আগের কথা। ‘ধীরে বহে মেঘনা’ যখন দেখি তখন আমার বয়স অতি অল্প। ‘মোহনা’ দেখিয়াছিলাম কিছু পরে।
আলমগীর কবিরের লেখা ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি ইংরেজি কেতাবও আমি একসময় পড়িয়াছিলাম। তিনি যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হাতেকলমে যোগ দিয়াছিলেন সে খবরটা তখনও আমার জানা হয় নাই—অন্তত অনেকদিন পর্যন্ত খবরটা জানিতাম না। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হইতে প্রচারিত তাঁহার ইংরেজি রাজনৈতিক ভাষ্যের সংকলনটি যখন প্রথম হাতে পড়িল তখনও মনে প্রশ্ন জাগিয়াছিল—কোন আলমগীর কবির? বাংলাদেশে আলমগীর কবির নামের টান পড়ে নাই অনেকদিন। কিন্তু এই আলমগীর কবিরের দ্বিতীয়টি কোথায়?
আমাদের আলমগীর কবির ইংরেজি ভাষাটা ভাল জানিতেন—সে খবর অবশ্য আমার অজানা ছিল না। তাঁহার একটা কি দুইটা বক্তৃতাও আমি সকর্ণে শুনিয়াছিলাম। কিন্তু ইংরেজি জ্ঞানের সহিত পাল্লা দিয়া তাঁহার রাজনৈতিক জ্ঞানও যে উঁচু পর্যায়ে উঠিয়াছিল—স্বীকার করিতে লজ্জা কি—সে জ্ঞান বহুদিন আমার ছিল না। পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ, তাঁহার লেখা ‘রেডিও বাংলাদেশ : ১৯৭১’ পড়িয়া এতদিনে সে জ্ঞানও হইল। তাই নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম—কেহ কি এই বইটির বাংলা করেন নাই, কেহ কি কোনদিন করিবেন না? সেই জিজ্ঞাসা প্রকাশ করি নাই। গোপনও করি নাই।
পাঁচজন নবীন লেখক—দেখিতে পাইতেছি—সত্যসত্যই আলমগীর কবিরের ‘রেডিও বাংলাদেশ : ১৯৭১’ অনুবাদ করিয়া আমার সেই অপ্রকাশিত বাসনা পূরণ করিয়াছেন। বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয়, আলমগীর কবির আজ বাঁচিয়া থাকিলে কতই না খুশি হইতেন। আহা! যদি অসময়ে অকালে নিহত না হইতেন, তাঁহার বয়স কত আজ হইত? তাঁহার জন্ম ১৯৩৮ সালের শেষাশেষি। বাঁচিয়া থাকিলেও আজ তাঁহার বয়স আশি পার হইত না। পাঁচজনের অনুবাদ হাতে পাইয়া একটা নাতিদীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। আমি সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ। মনে হইল, কবির মরেন নাই। পুনশ্চ মনে হইল, আলমগীর কবির মরিয়া প্রমাণ করিয়াছেন—তিনি মরেন নাই।
১
কেমন মানুষ ছিলেন আলমগীর কবির? ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ এক আত্মকথাযোগে তিনি জানাইয়াছিলেন, ‘যা হোক, ইচ্ছে আছে অন্তত আগামী কয়েক বছর ছবি করে যাব। বলা বাহুল্য, এসব ছবিতে কেবল নিজ জীবনের টুকরো অভিজ্ঞতাগুলোই নয়, অনেক ব্যক্তিগত অথচ পরিশীলিত ধ্যানধারণা বিশ্বাসের প্রতিফলনও ঘটবে।’ (কবির ১৯৭৭ : ২৬)
আহা, আয়ুতে কুলাইল না! সৌভাগ্যক্রমে তাঁহার রাজনৈতিক ধ্যানধারণার অংশবিশেষ ‘রেডিও বাংলাদেশ: ১৯৭১’ বইতে ধরা পড়িয়াছিল। যত দীন চেহারায় হউক, তাহাদের হারাইয়া যাইতে দেন নাই তিনি। ১৯৭৭ সালের যে লেখা হইতে উপরে দুই ছত্র উদ্ধার করিলাম সে লেখারই আর দুই ছত্রযোগে তিনি আপন বিশ্বাসের মূলসূত্র ধরাইয়া দিয়াছিলেন এইভাবে—‘এই মাটিকে ভালোবাসি বলেই বাইরের জগতটাকেও ভালবাসতে শিখেছি। এই মাটির বন্ধু আমার বন্ধু। শত্রু আমার শত্রু। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অন্তর দিয়ে ভালবাসি প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদকে।
অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি সাম্প্রদায়িকতাসহ সব রকমের কূপমণ্ডূকতাকে।’ (কবির ১৯৭৭ : ২৬)
আলমগীর কবিরের এই রাজনৈতিক আদর্শের প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনেক আছে। এক প্রমাণ আমাদের হাতে ধরা তাঁহার এই কীর্তি—‘দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ: ১৯৭১’। এই বই কি করিয়া লেখা হইয়াছিল তাহার ইশারা কবির নিজেই বইটির মুখবন্ধযোগে দিয়াছেন। ১৯৮৯ সালে তাঁহার মৃত্যুর কিছুদিন পর লেখা একপ্রস্ত স্মৃতিকথা বাবদ জ্যেষ্ঠ সহকর্মী কামাল লোহানীও ইহার চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্য দিয়াছেন। লোহানী লিখিয়াছিলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে জহির [অর্থাৎ জহির রায়হান] চরমভাবে ব্যস্ত হয়ে গেলেন ছবি অর্থাৎ যুদ্ধের প্রামাণ্য ছবি করতে, সেই সাথে কবিরও প্রচণ্ডভাবে জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতারের দায়িত্ব তাঁর অব্যাহত ছিল।’ (লোহানী ১৯৯১ : ৩১)
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি নাম ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রাখিয়াছিলেন আলমগীর কবির। বলা বাহুল্য নহে, রাখিয়াছিলেন তিনি একাই। সেদিন তাঁহার এই নামকরণের সহিত এমনকি কামাল লোহানী পর্যন্ত একমত ছিলেন না। লোহানী লিখিয়াছিলেন, ‘দিস ইজ রেডিও বাংলাদেশ’ বলে স্টেশন কল দিয়ে ইংরেজি প্রোগ্রামের সমস্ত কাজটাই তিনি করতেন, সাথী তাঁর আজকের প্রখ্যাত নাট্য প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকর্মী আলী যাকের—না, তখন তাঁর নাম ছিল আবু মোহাম্মদ আলী।’ (লোহানী ১৯৯১ : ৩১)
স্মৃতি দেখিতেছি কামাল লোহানীর সহায়তা ষোল আনা করে নাই এখানে। আলী যাকের তখন তখনই তাঁহার সাথী হন নাই। আলমগীর কবির স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়া শরিক হইয়াছিলেন ১৯৭১ সালের ১২ জুন নাগাদ। তাঁহার লেখা প্রথম কথিকা প্রচারিত হইল ১৫ জুন। প্রথম দিকে—বেশ কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত—সব কাজ তিনি একাই করিতেন। আলী যাকের সেখানে যোগ দিয়াছিলেন আর কিছুদিন পরে।
ইতিহাসের খাতিরে এই সত্যটা যাচাই করিয়া লওয়া মন্দ নহে। আলমগীর কবিরের নিজের লেখা ১৯৮৪ সালের মুখবন্ধেও এই সত্যের উল্লেখ আছে। আগে কামাল লোহানীর কথায় ফিরিয়া আসি। তিনি জানাইতেছেন, ‘আহম্মদ চৌধুরী নামধারী আলমগীর কবির পরিকল্পনা করতেন, লিখতেন, সাজাতেন, রেকর্ড করতেন সমস্ত প্রোগ্রামটাই। ভয়েস তো দিতেনই। এ ছিল তার নিত্য কাজ। ভদ্রলোক বলতেন “দিস ইজ রেডিও বাংলাদেশ, মুজিবনগর”। পুরো নিউজের দায়িত্বে ছিলাম আমি, আমার এতে ঘোরতর আপত্তি ছিল।’ (লোহানী ১৯৯১ : ৩১)
আপত্তির কারণটাও ব্যাখ্যা করিয়াছেন লোহানী। তাঁহার মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁহারা লড়াই করিতেছেন তাঁহাদের প্রচার যুদ্ধেও তো সেই স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটাইতে হইবে। তিনি চাহিতেন ইংরেজি অনুষ্ঠানেও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ কথাটাই ব্যবহার করা হউক। কিন্তু আলমগীর কবির তাঁহার সহিত একমত হইতে পারেন নাই। কামাল লোহানীর হতাশা এইভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে: ‘কিন্তু আমি চাইলে কি হবে। এই পলিটিকাল ডিসিশন দেবার কেউ ছিল না। ছিল না কোন পলিটিক্যাল সেল। তাই উনি যেটা বিশ্বাস করতেন সেটা চালিয়ে যেতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছে, তখন তো বাংলাদেশ হবেই। সুতরাং আগে থেকে বলতে ক্ষতি কি!’ (লোহানী ১৯৯১ : ৩১)
১৯৮৪ সালে ‘রেডিও বাংলাদেশ : ১৯৭১’ প্রকাশের প্রাক্কালে মুখবন্ধ উপলক্ষ্যে আলমগীর লিখিয়াছিলেন, ‘আমার আশা মাত্র এই নহে যে এই বইটি যুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘরে জমা থাকিবে, আশা করি বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতি বিষয়ে যাহারা পড়াশোনা করিবেন বইটি তাহাদেরও কাজে লাগিবে।’ (কবির ১৯৮৪ : ১)
২
এই নাতিদীর্ঘ বহিটির প্রায় সকল লেখাই আমি একনাগাড়ে পড়িয়া শেষ করিয়াছি। কিন্তু এই বই মোটেও একনাগাড়ে পড়িয়া ফুরাইবার জিনিশ নহে। এই বই—এককথায় বলিতে—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যত দলিল এই পর্যন্ত পড়িয়াছি তাহাদের সব কটিকেই ছাড়াইয়া গিয়াছে—অন্তত রাজনৈতিক চিন্তার উৎকর্ষে। এই বই পড়িবার পর আমার মনে হইয়াছে আলমগীর কবির ১৯৭৭ সালে যাহা বলিয়াছিলেন (যাহার কিছু অংশ উপরে উদ্ধার করা হইয়াছে) তাহাতে সকল কথা বলেন নাই—কিছু কিছু কথা লুকাইয়াছিলেনও হয়তো। যেমন তিনি বলিয়াছিলেন তিনি অন্তর দিয়া ভালবাসেন প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ আর ঘৃণা করেন সাম্প্রদায়িকতাসহ সব ধরনের কূপমণ্ডূকতা। কথাগুলি মিথ্যা ছিল না, ছিল মাত্র খানিকটা অপূর্ণ—এই যাহা। ‘রেডিও বাংলাদেশ: ১৯৭১’ বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়াছিলাম বিশুদ্ধ একজন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে আর যে দলটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেছিল আমি সেই আওয়ামী লীগ দলের সদস্য কোনদিনও ছিলাম না।’ (কবির ১৯৮৪ : ১)
তারপরেও প্রবাসে গঠিত বাংলাদেশ সরকার তাঁহার উপর আস্থা স্থাপন করিয়াছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ময়দান হইতে তিনি যাহা প্রচার করিয়াছিলেন তাহা এতদিন পরেও—অন্তত আমার কাছে—একান্ত জীবন্তই মনে হইতেছে। দুই চারিটা উদাহরণ দিয়া এক্ষণে অন্য প্রসঙ্গে যাইতেছি।
১৯৭১ সালের ১৫ জুন প্রচারিত প্রথম কথিকায় আলমগীর কবির প্রশ্ন করিয়াছিলেন, বাংলাদেশে এত বড় একটা বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয় হইয়া যাইতেছে—এত বড় মাপের একটা গণহত্যা ঘটিতেছে—তারপরও পাশ্চাত্য জগতের জনমত প্রতিবাদে ইহার বিরুদ্ধে সরব হইয়া উঠিল না কেন? নিজের প্রশ্নের যে জওয়াব তিনি নিজে দিয়াছিলেন তাহা আজও অপ্রাসঙ্গিক হইয়া যায় নাই। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে যে গণহত্যার যুদ্ধ শুরু করিয়াছেন তাহা বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক চরিত্রের যুদ্ধ। অথচ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একদিন যাঁহারা গলা ফাটাইয়া লড়াই করিতেন আজ তাঁহারা কোথায়? তাহাদের পা হইতে মাথা পর্যন্ত বিস্তৃত এই অনীহা দেখিলে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে, কারিগরি বিচারে বর্তমান সভ্যতা যতই অগ্রগামী হউক না কেন, মন ও প্রাণের দিক হইতে সে মোটেও আগায় নাই—সেই উপনিবেশ ব্যবসায় আর দাস বাণিজ্যের যুগে যেখানে ছিল আজও সেখানেই পড়িয়া রহিয়াছে সে।’ (কবির ১৯৮৪ : ৩)
১৬ জুনের কথিকায় বিমূর্ত হইতে প্রমূর্তে নামিয়া আসিয়াছিলেন তিনি। লিখিয়াছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের গণহত্যার যুদ্ধ থামাইতে জাতিসংঘ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারে নাই দেখিয়া দুনিয়ার বিবেক যারপরনাই আঘাত পাইয়াছে। যন্ত্রণায় কাতর লাখ লাখ মানুষ বৃথা বসিয়াছিল জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট কিছু একটা করিবেন এই আশায়—তিনি ফ্যাসিবাদী সামরিক জান্তার দস্যুবাহিনীর দঙ্গলগুলিকে কমসে কম লাগাম টানিয়া থামাইবেন। এই দঙ্গলগুলি নিরপরাধ পুরুষ, নারী ও শিশু মারিয়া-কাটিয়া শেষ করিতেছে, অথচ খোদ ইয়াহিয়া আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দেওয়া ছাড়া এই মানুষগুলি রাজনীতিতে আর মাথা ঘামায় নাই। জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদল উ থান্ট সাহেবকে প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া বুঝাইয়াছেন তিনি যেন নিরাপত্তা পরিষদের ঘুমটা একটু ভাঙ্গাইবার কোশেস করেন—জানাইতে চেষ্টা করেন যে শুদ্ধমাত্র এই উপমহাদেশের নহে, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের শান্তি আজ বিপন্ন। অথচ উ থান্ট কিছুই করিলেন না। তিনি বলিলেন, একমাত্র ইয়াহিয়া খান যদি চাহেন তো তিনি দুর্গতদের জন্য মানবিক সহায়তা দান করিতে রাজি আছেন।
কিন্তু ইয়াহিয়া খান নিজেই যাহাদিগকে সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক হেন মহাদুর্যোগে নিপতিত করিয়াছেন তাহাদিগকে বিপদে রক্ষা করিবার ইচ্ছা তাঁহার থাকিবে কেন? মহাসচিব মহোদয় কিন্তু এই রক্তপাত আর গণহত্যার ঘটনা সবই জানেন। কেননা যে একজন কি দুইজন জাতিসংঘ কর্মকর্তা মার্চ মাসে ঢাকা ছাড়িয়া চলিয়া যান নাই তাঁহাদের মধ্যস্থতায় তিনি সমস্ত ঘটনার বিবরণ পাইয়াছেন। এই লোমহর্ষক ঘটনার কাহিনী অবশ্য তাঁহাকেও ব্যক্তিগতভাবে ব্যথা দিয়াছে, ঘৃণায় কুঞ্চিতও হইয়াছেন তিনি—সে কথা প্রকাশ্যে বলিতে তিনি বাধ্যই হইয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, মনুষ্যজাতির ইতিহাসে ভয়াবহতম যত বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটিয়াছে এই ঘটনা তাহাদের পর্যায়ের।’ (কবির ১৯৮৪ : ৫)
আলমগীর কবিরের এই বহিতে কথিকা পাওয়া যাইবে গুণিয়া দেখিলে মোট একাশিটি। বেশির ভাগ কথিকায় তিনি পাক সামরিক চক্রের চরম নীতির মুখোশ খুলিয়া দিয়াছেন, তাহাদের কৌশল কেন ব্যর্থ হইবে তাহাও প্রকাশ করিয়াছেন। যুদ্ধকালীন প্রচারের অংশ হইলেও আলমগীর কবির কোথাও সত্যের সীমা অতিক্রম করেন নাই। এ কথা তিনি নিজেও যেমন জানেন—মুখবন্ধে সে কথার পুনরুল্লেখ আছে—আমরাও তেমন দেখিলাম। ২৫ জুন তারিখের কথিকায় তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করিয়াছিলেন, ততদিনে বাংলাদেশের দশ লাখ মানুষ নিহত হইয়াছেন আর পঞ্চাশ লাখ মানুষ দেশ ছাড়িয়া শরণার্থী। (কবির ১৯৮৪ : ১৪)
১২ আগস্ট তারিখে প্রচারিত এক কথিকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে তখন পর্যন্ত নিহত মানুষের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিলেন। আলমগীর কবির ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ হইতে নিজহাতে লেখা সর্বশেষ কথিকা প্রচার করিয়াছিলেন ৩০ নবেম্বর। আগের দিন—২৯ নবেম্বর—তিনি যে কথিকাটি পড়িয়াছিলেন তাহাতেও উল্লেখ করা হইয়াছিল, ততদিনে বাংলাদেশে ২০ লাখের মত মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন, আর দেশত্যাগ করিয়াছেন আর এককোটি মানুষ। দেশত্যাগের স্রোত তখনও বন্ধ হয় নাই। (কবির ১৯৮৪ : ৯২, ১৮২)
‘রেডিও বাংলাদেশ : ১৯৭১’ বইয়ের উপসংহার অধ্যায়ে আলমগীর কবির জানাইয়াছেন ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় বিজয়ের লক্ষ্যে শেষ লড়াই যখন শুরু হইল তখন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছাড়িতে বাধ্য হইলেন। সিদ্ধান্ত করিলেন, পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধের শেষ অঙ্কের প্রামাণ্য কিছু ছবি ধরিয়া রাখিবেন। মহারাষ্ট্র দেশের বিখ্যাত অনুষ্ঠান পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ছাত্র কামাল নায়েকের সঙ্গে মিলিয়া আলমগীর কবির ডিসেম্বর মাসের ৭ তারিখে যশোহর পতনের দৃশ্যাদি সচলচিত্রবন্দী করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ৮ ডিসেম্বর যশোহরে—যুদ্ধবিজয়ী জাতির দেশে—যে জনসভার অনুষ্ঠান হয় তাহাতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ঢাকায় আত্মসমর্পণ করিল। তবে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে নিযুক্ত পাকিস্তানী সেনানায়করা অস্ত্র সমর্পণ করিতে আরও দুই দিন দেরি করেন। পরিশেষে ১৮ ডিসেম্বর তারিখে খুলনা শহরের সার্কিট হাউস ময়দানে তাহারা বাংলাদেশ বাহিনীর ৯ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিলের কাছে মাথা নত করেন। সেই সময়কার দৃশ্যগুলি ক্যামেরায় ধারণ করিয়াছিলেন আলমগীর কবির। পাক সেনাবাহিনীর শেষদিককার গণহত্যার অনেক প্রমাণ—আরো বহু দলিল—তিনি আলোকচিত্রে ধারণ করিতে সমর্থ হন। কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবিতে এই সকল দলিলের কিছু কিছু দেখান হইয়াছে।
৩
আলমগীর কবিরের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও চলচ্চিত্র-প্রজ্ঞার পূর্ণ একটা চিত্র আঁকিবার সুযোগ এই ছোট্ট ভূমিকায় নাই। শুদ্ধ নমুনা আকারে আর দুই চারিটা জায়গা মাত্র ছুঁইয়া যাইতে চাহি। পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নীতি ও কৌশলের উপর লেখার কথা ছাড়িয়া দিলে তাঁহার লেখা আর যে সকল প্রসঙ্গে বারবার ফিরিয়াছে তাহার শীর্ষে সেদিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। আগস্ট মাসের ৭ ও ৯ তারিখে পরপর দুইবার প্রচারিত একটি কথিকার নামেই বক্তব্যের সার প্রকাশ পায়। কথিকার নাম: ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ফারল্যান্ড কি করিতেছিলেন? গণহত্যার পরিকল্পনা কি নিক্সনের অনুমোদন লাভ করিয়াছিল?’
যখন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনার অভিনয়টা চালাইয়া যাইতেছিলেন তাহার মধ্যেই একদিন—১৯৭১ সালের ২০ মার্চ—এসলামাবাদে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড গোপনে অতি সন্তপর্ণে ঢাকায় আসিয়াছিলেন। ঢাকায় আসিয়া কি কাণ্ডটা করিতেছিলেন তিনি? মার্চের ২৩ তারিখ সকাল ১০টার দিকে একটি সাধারণ শেভ্রোলে গাড়ি চাপিয়া ঢাকার সেনাছাউনির দিকে তাঁহাকে যাইতে দেখিয়াছিলেন একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। ইনি হইলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দুই নম্বর আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব সে কথাটা তখন তখনই সাংবাদিকদের জানাইয়াছিলেন। সেই সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন আলমগীর কবির নিজেও। খবরটা জানান সত্ত্বেও হামিদুল হক চৌধুরীর ‘পাকিস্তান অবজার্বার’ পত্রিকা সেদিন ছাপাইতে রাজি হয় নাই। এই তথ্য আলমগীর কবির আগেই জানিতে পারিয়াছিলেন। তিনিও খবরটা ছাপাইতে পারেন নাই। ততদিনে ২৫ মার্চের অবিস্মরণীয় রাত্রি আসিয়া গিয়াছে। কবির তখন তখনই ঠাহর করিয়াছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানী গণহত্যা পরিকল্পনার সহিত জড়িত।
তথ্য না জানিয়া সাংবাদিকতা করিলে কি অন্যায়, কি অপযশ হয় তাহার একটি করুণ দৃষ্টান্তও আলমগীর কবির দিয়াছেন। কবির লিখিয়াছেন, ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য যে আন্দোলন চলিতেছে মার্কিন সরকার যে সে আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করিতে পারে সে সম্ভাবনা নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা একপ্রকার উড়াইয়াই দিয়াছিলেন। তাহার একটি কারণ এই যে কোন কোন বামপন্থী পত্রিকা নিরন্তর প্রচার করিয়া যাইতেছিল শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ উভয়েই মার্কিন প্রশাসনের আজ্ঞাবহ। আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার অনুসারী গোপন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র [সাপ্তাহিক] “গণশক্তি” ২৪ মার্চ সংখ্যায় কেহ একজন দৃঢ়তার সহিত লিখিয়াছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালির দৌলতে মুজিব-ইয়াহিয়া সমঝোতা হইয়া যাইতেছে। পত্রিকাটি অভিযোগ করে—পত্রিকার নিজস্ব ভাষায় ‘সাম্রাজ্যবাদ’ প্রস্তাবিত আপোসরফায় উপনীত হইয়া শেখ মুজিব বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিতেছেন। এই পত্রিকার মতে আপোসরফার উদ্দেশ্য ছিল নিখিল পাকিস্তানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নস্যাত করিয়া দেওয়া।’
ঐ পত্রিকার সম্পাদকের নাম তিনি উল্লেখ করেন নাই। এখন সকলেই জানেন ইনি আর কেহই নহেন, ছিলেন অভিজাত বামপন্থী বদরুদ্দীন উমর। আলমগীর কবির একটা মন্তব্য করিয়াই অনুচ্ছেদটি শেষ করিয়াছিলেন: ‘সাপ্তাহিকটির সম্পাদক মহোদয় এখন নিশ্চয়ই নিজের কথাগুলি নিজেই গিলিয়া খাইতেছেন।’ (কবির ১৯৮৪ : ৮৪)
আলমগীর কবির সে যুগের চীন সরকারকে ধরিয়াও এরকম অনেক সত্য সহজে কথন করিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, চীন বিশ্ব-সমাজতন্ত্রের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিতেছে। আরব জাহানের যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের তাৎপর্য ধরিতে পারে নাই তাঁহাদেরও ছাড়িয়া কথা বলেন নাই তিনি। ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেও একই কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। সুখের মধ্যে, ফিলিস্তিন মুক্তি-সংস্থার নেতারা—বিশেষ করিয়া ইয়াসের আরাফাত—সেদিন বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে আগাইয়া আসিয়াছিলেন। (কবির ১৯৮৪ : ১৪)
আগেই বলিয়াছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে আলমগীর কবিরের শেষ কথিকা-নিবন্ধটি প্রচারিত হইয়াছিল ৩০ নবেম্বর। এই নিবন্ধেও তিনি চীনের নীতির বিশদ সমালোচনা করেন। তাঁহার এই বিশ্লেষণ বেশ শিক্ষাপ্রদ। চীনের নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে নানান কথা বলিলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে সত্যসত্য নামেন নাই। একথা সত্য, ভারত আগেভাগেই রুশিয়ার সহিত চুক্তি করিয়া বসিয়াছিল এই চীনের ভয়েই।
কিন্তু ততদিনে চীনের হৃদয়েও একটা ফাটল দেখা দিয়াছিল। আলমগীর কবির তাহার আভাস দিয়াছিলেন এইভাবে : ‘২৫ মার্চের পর হইতে আজ পর্যন্ত চীন [বাংলাদেশের] মুক্তিবাহিনী কিংবা সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সরকারের মুখোমুখি বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে নাই—একথা সত্য বটে। ২৫ মার্চের পর হইতে ঘাতকচক্রের হাতে ঐ দেশটি একটি গুলিও তুলিয়া দেয় নাই—এই খবর আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাইয়াছি। খুবই ভাল কথা। কিন্তু তাহা কি যথেষ্ট? যে দেশ বা রাষ্ট্র দাবি করিয়া থাকে তাঁহারা জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রামরত নির্যাতিত মানবজাতির পক্ষে প্রথম সারির সৈনিক সেই দেশ বা রাষ্ট্রের এই কি যথার্থ ভূমিকা? আমার তো মনে হয়, যথার্থ নহে।’ (কবির ১৯৮৪ : ১৮৪)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত প্রস্তাবেই হইয়া উঠিয়াছিল বিপ্লবী গণযুদ্ধ। মনে রাখিতে হইবে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধটা ছিল এদেশের সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের বিরুদ্ধে। এখানেই গড়িয়া উঠিয়াছিল গণযুদ্ধের জাতীয় ভিত্তি। আলমগীর কবির বড়ই পরিষ্কার ভাষায় লিখিয়াছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত একটি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যে যুদ্ধে রত তাহার একদফা বড় ফল ফলিয়াছে—এই ফলের নাম ধর্মনিরপেক্ষতা।’ (কবির ১৯৮৪ : ২৩)
তবে তাঁহার সকল ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্য প্রমাণিত হইয়াছে? কাহার যে হয়! তাঁহারই বা হইবে কেন! ‘ধর্মনিরপেক্ষতার আবির্ভাব’—নামক প্রবন্ধে তিনি আরও লিখিয়াছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশ যখন একদিন স্বাধীন হইবে তখন কি এদেশে সাম্প্রদায়িকতা আবার জাগিতে পারিবে? প্রশ্নটা যে কেহ জিজ্ঞাসা করিতেই পারেন। উত্তর হইতেছে, না—পারিবে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যস্থতায় সমাজের ভিত্তিমূলে স্থাপিত অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের বেশির ভাগই লোপ পাইবে। নতুন যে দেশের যাত্রা শুরু হইবে সেদেশে একমাত্র সামর্থ্য আর প্রয়োজন ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টনের অন্য কোন মাপকাঠিই থাকিবে না। ২৫ মার্চের আগে যে যে ধর্মীয় পরিচয় বা সামাজিক কাঠাম বহাল ছিল নতুন রাষ্ট্রের গঠন-প্রক্রিয়ায় তাহাদের কোনটাই আর পাত্তা পাইবে না।’ (কবির ১৯৮৪ : ২৫)
এই কথা পড়িলে মনে হইবে আলমগীর কবির শুদ্ধ কর্মবীরই ছিলেন না, ছিলেন মহান স্বপ্নদ্রষ্টাও। তাঁহার এই বিশ্লেষণকে স্বপ্ন ছাড়া আর কিই বা বলা যায়! মনে হইতেছে আপাতত তাঁহার অনেক স্বপ্ন ব্যর্থ হইয়াছে। তবে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র : ১৯৭১’ এই রকম আরও বহু স্বপ্নের প্রমাণ বুকে ধরিয়া রাখিয়াছে। আলমগীর কবিরের মত মানুষ যদি এদেশে আর পাঁচটি জন্মাইতেন তো হয়তো তাঁহার এত স্বপ্ন ষোল আনা বৃথা যাইত না!
৪
আলমগীর কবির আমাদের ছাড়িয়া গিয়াছিলেন ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি। এই মৃত্যু যে অকালমৃত্যু তাহাতে বিতর্কের অবকাশ নাই। একটি ট্রাকের ধাক্কায় তাহার গাড়ি ফেরি হইতে নদীতে পড়িয়া গেল। সহকর্মী টিনা খান ও তিনি মরিয়া গেলেন। সকলেই মানিয়া লইয়াছেন এই মৃত্যু নিতান্তই দুর্ঘটনা। যেন ইহাতে প্রশ্ন করিবার কিছু নাই। কি কারণে জানি না, দুর্ঘটনার এই উপপাদ্যটা আমি প্রাণ হইতে পুরা মানিয়া লইতে পারি নাই। আমি তখন দেশে থাকি না, থাকি দূরদেশে। সে দেশটি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাহায্য করে নাই। কয়েকদিন পর খবরটা কাগজে পড়িলাম। আশপাশে কাহারও সহিত আলোচনার উপায়ও ছিল না। সে ছিল শুদ্ধ শূন্যে তাকাইয়া থাকিবার দিন। কেবল ভাবিতাম, এই দুর্ঘটনার পিছনে আরও ঘটনা থাকিলেও থাকিতে পারে।
অনেকদিন পর ‘আলমগীর কবিরের শেষ ভাষণ’ নামের একটি স্মারক সংকলনে মুদ্রিত একটি লেখা পড়িয়া মনে হইল আমার সেদিনের দুর্ভাবনাটা একান্তই ভিত্তিহীন ছিল না। যে দিন—২০ জানুয়ারি ১৯৮৯—বিকালে কবির প্রাণ দিলেন সেদিন সকালে—ঘড়ির কাঁটায় মিলাইয়া ঠিক দশটায়—তিনি বগুড়া পাবলিক লাইব্রেরির ময়দানে দাঁড়াইয়া সর্বসমক্ষে বলিয়াছিলেন, ‘ছবিতে সবসময় সত্য কথা বলতে হবে।’ সত্য কথা মানে? তিনি বলিয়াছিলেন, ‘সমাজের কথা, জীবনবোধের কথা, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছু নিয়েই কথা বলতে হবে।’
তখন দেশের সর্বময় ক্ষমতা এক সেনাপতির হাতে। সকলেই তাঁহাকে চেনেন। তাই তাঁহার নামধাম উল্লেখ না করিয়াই আলমগীর কবির বলিতেছিলেন, ‘এসব ব্যাপারে বর্তমান সরকার প্রধানকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। তিনি সৈনিক। অস্ত্র নিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর কাছে গণতন্ত্র আশা করাটাও বৃথা। বরং তিনি যা করছেন সেটাই বেশি। দোষ তাঁদের, যাঁরা আমাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। আবার ক্ষমতার লোভে সাহায্য করছেন বর্তমান সরকার প্রধানকে।’
আলমগীর কবির প্রাণের ভয় করিতেন না। এই নিঃশঙ্কচিত্তের, এই নির্ভয় প্রাণের পরিচয় তিনি ১৯৭১ সালের আগেও অনেকবার দিয়াছেন। ১৯৭১ সালে তো বটেই, ১৯৭১ সালের পরেও দিয়াছেন। তিনি আমৃত্যু ভয়কে জয় করিয়া বাঁচিতেন। শেষ ভাষণের শেষ কথায়ও তাহার প্রমাণ এইরকম: ‘ফিল্মে এদের কথা, এসব কথা দেখাতে হবে। ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এ সরকারের ভিত্তি খুব দুর্বল। আপনাদের কিছু করতে পারবে না। আসলে আমরা নিজেরাই নিজেদের ভয় পাই বলে এসব ছবিতে আনি না। আপনারা ভয় পাবেন না। নির্দ্ধিধায়, মুক্ত মনে, মুক্ত দৈর্ঘ্যের ছবি দিয়ে এসব সত্য উন্মোচন করবেন দর্শকদের সামনে।’ (কবির ১৯৮৯ : ৬৫)
আলমগীর কবিরের এইসব কথা নেহায়েত ফাঁকাবুলি ছিল না। তাঁহার জীবনের প্রতিটি অলি ও গলি ইহাই প্রমাণ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর হইতে যে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হইয়াছিল তাহার ঢের আগে হইতেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁহাকেও নিরাপত্তা আইনে বন্দী করিয়া কারাগারে আটক করিয়া রাখিয়াছিল। হাইকোর্টে মামলা রুজু করিয়াও তাঁহার জামিন বা মুক্তি মেলে নাই। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনই তাঁহাকে জেলের তালা ভাঙ্গিয়া মুক্ত একদিন করে।
আলমগীর কবিরের কীর্তি আরও একটু দূর হইতে দেখিবার জিনিশ। শুদ্ধ বাংলাদেশের কেন, আলজিরিয়ার মুক্তি সংগ্রামেও তিনি জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। ফিলিস্তিনিদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেও তাঁহার সক্রিয় যোগ ছিল। আর বলা বাহুল্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইবার পর তিনি দেশত্যাগ করিয়া বিদেশে গেলেন আর সেখানে গিয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সহিত যুক্ত হইলেন। সেদিন তাঁহার সহিত একযোগে ঢাকা ছাড়িয়াছিলেন এমন অন্তত দুইজনের কথা আমরা জানি যাঁহারা সোজা লন্ডনে গিয়া হাজির হইয়াছিলেন। যুদ্ধে যোগ দিতে রাজি হন নাই। আলমগীর কবিরও যুক্তরাজ্যের নাগরিকতা পাইয়াছিলেন কিন্তু তাহার সদ্ব্যবহার করেন নাই।
কার্ল মার্কস একদা প্রসঙ্গক্রমে বলিয়াছিলেন, বিদেশি ভাষা হইতেছে জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার। আলমগীর কবিরের জীবনে এই সত্য ধ্রুবের মর্যাদা পাইয়াছিল। কবির সেই ১৯৫০ সালের দশকেই হিজরত করিয়াছিলেন ইংরেজ জাতির দেশে। গিয়াছিলেন পড়াশোনার টানে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকও হইয়া গিয়াছিলেন কোন একপর্যায়ে। ইংরেজি ভাষায় তাঁহার অধিকারও প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তিনি। ভাষা ও নাগরিকতার এই হাতিয়ার দুইটাই তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পুরাদস্তুর কাজে লাগাইয়াছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শত শত বুদ্ধিজীবী প্রাণ দিয়াছিলেন। এখনও ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই আমাদের মনে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ শব্দবন্ধ আসিয়া হাজির হইয়া থাকে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা শুদ্ধ শহীদই হন নাই, অনেক বুদ্ধিজীবী লড়াইও করিয়াছিলেন, লড়াই করিয়া বাঁচিয়াও ছিলেন—গাজী হইয়া বাড়ি ফিরিয়াছিলেন। দেশ স্বাধীনতা লাভ করিবার প্রায় দেড় যুগ পরে নিহত আলমগীর কবির (১৯৩৮-১৯৮৯) ছিলেন তেমনই একজন গাজী বুদ্ধিজীবী।
২৩ জানুয়ারি ২০১৭
দোহাই
১. আলমগীর কবির, ‘আলমগীর কবিরের শেষ ভাষণ,’ স্মরণিকা, আজিজ মেহের প্রমুখ সম্পাদিত (ঢাকা : বাংলাদেশ সৎ চলচ্চিত্র ফ্রন্ট, ১৯৮৯), পৃ. ৬৪-৬৫।
২. আলমগীর কবির, ‘চলার পথের কিছু ভাবনা,’ চলচ্চিত্রিক, এ.এইচ.এম. মহিবুল্লাহ সম্পাদিত (ঢাকা : আগস্ট, ১৯৭৭)।
৩. কামাল লোহানী, ‘স্মৃতিতে কবির অম্লান,’ আলমগীর কবির স্মারকগ্রন্থ, তানভীর মোকাম্মেল সম্পাদিত (ঢাকা : বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ, ১৯৯১), পৃ. ২৯-৩৩।
৪. Alamgir Kabir, This Was Radio Bangladesh: 1971 (Dacca: Bangla Academy, 1984).
(এই নিবন্ধটি আলমগীর কবির রচিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামক গ্রন্থের ভূমিকা আকারে লেখা হইয়াছে। বইটি ফেব্রুয়ারি (২০১৭) মাসে প্রকাশিত হইবে।)