জীবনানন্দের জন্মস্থান ও জন্মতারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি
জীবনানন্দ দাশের জন্ম বরিশাল শহরে; এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং জীবনানন্দের জীবনীকাররা এটিকেই সত্য বলে মানেন; এমনকি জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের লেখায়ও বিষয়টি স্পষ্ট যে, ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার চেয়ে বড় কথা, জীবনানন্দ নিজেই একটি চিঠিতে লিখেছেন যে তাঁর জন্ম বরিশালে। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে তর্ক উঠছে।
অনেকদিন ধরেই এরকম একটি জনশ্রুতি রয়েছে যে, জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে নয় বরং জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁর পাশের জেলা ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি নদীর অদূরে বামনকাঠি গ্রামে। এক বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে বরিশাল শহরে গিয়ে স্থায়ী হয়েছিলেন তিনি। এই জনশ্রুতি নির্মাণের একটি বড় কারণ সম্ভবত ধানসিঁড়ি নদী।
ধানসিঁড়ি নদীর অবস্থান ঝালকাঠিতে। পঞ্চম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী গাবখান সেতুর ওপর দিয়ে ভাটার সময় এ নদীটি দেখা যায়। ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিষখালী নদীর মোহনা থেকে উত্তর দিকে বয়ে গেছে গাবখান চ্যানেল। চ্যানেলে প্রবেশের পরপরই হাতের বাঁ দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে সরু যে খালটি চলে গেছে রাজাপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া নদী পর্যন্ত, সেটিই ধানসিঁড়ি। দৈর্ঘ্য প্রায় আট কিলোমিটার।
কেউ কেউ ধারণা করেন, এ নদীতীরের কোথাও জীবনানন্দের এক আত্মীয়ের বাড়ি ছিল এবং তিনি সেখানে মাঝেমধ্যে আসতেন। কিন্তু সে বাড়িটি আসলে কোন জায়গায় ছিল এবং আত্মীয় কে—তা এখন আর কেউই বলতে পারেন না।
ঝালকাঠির সাহিত্য সংগঠন কবিতাচক্রের প্রকাশনা ‘সরণি’র ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সংখ্যায় স্থানীয় একটি কলেজের একজন শিক্ষক ‘ধানসিঁড়ি নদী ও জীবনানন্দ দাশ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানসিঁড়ি নদীর পাশের গ্রাম বামনকাঠির দাশ পরিবারে। তাঁর প্রপিতামহ মহেন্দ্র কুমার দাশগুপ্তর বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে। পদ্মার ভাঙনে তাঁর ছোট তালুকটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি। মৃত্যুর পর তিনি তাঁর তিন ছেলে সর্বানন্দ, নিত্যানন্দ ও প্রেমানন্দ দাশগুপ্ত পানসি করে ভাটির উদ্দেশে পাড়ি জমান।’
এই লেখায় তিনটি ভুল রয়েছে। জীবনানন্দের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি। দ্বিতীয়ত তাঁর প্রপিতামহের নাম মহেন্দ্র কুমার নয়, বরং বলরাম দাসগুপ্ত। তৃতীয়ত জীবনানন্দের প্রপিতামহের তিন ছেলের নামের ক্ষেত্রে সোহরাব হোসেন জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দের নাম সঠিক লিখলেও বাকি দুজনের নাম ভুল লিখেছেন। বাকি দুই ছেলের নাম তারিনীচরণ ও ভোলানাথ।
প্রভাতকুমার দাস রচিত ‘জীবনানন্দ দাশ’ গ্রন্থটিকে যদি আমরা তাঁর মূল জীবনীগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সেখানে দেখা যাবে, জীবনানন্দের জন্মস্থান উল্লেখ করা হয়েছে বরিশাল শহর। শুধু তাই নয়, কীর্তনখোলাবিধৌত বরিশাল শহরের নৈসর্গিক পরিবেশের বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি।
প্রভাতকুমার লিখেছেন, ‘খালবিল নদীনালা বন বনানীঘেরা প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত জেলা শহরটির সঙ্গে দূরদূরান্তের গ্রামগুলির যোগাযোগ আঁকাবাঁকা পায়ে চলার পথ দিয়ে গাঁথা।...গাঁ-গৃহস্থবাড়ি গাছপালা শস্য ফসলঘেরা মনোরম পটে লেখা মফস্বল শহরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ (বঙ্গাব্দ ১৩০৫ ফাল্গুন ৬) শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।’
এখানেই শেষ নয়। ‘জীবনানন্দ স্মৃতি ময়ুখ’-এ (পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২) প্রকাশিত কোনো এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে লেখা একটি চিঠিতে স্বয়ং জীবনানন্দ লিখেছিলেন: ‘আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ফাল্গুন মাসে।’
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ ‘উত্তরসূরী’ পত্রিকার ‘জীবনানন্দ স্মরণে’ সংখ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার দাদা শ্রীযুক্ত জীবনানন্দ দাশ ১৩০৫ সালে ৬ ফাল্গুন বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।’
আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশ : মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার’ বইতেও অশোকাননন্দ দাশ ‘জীবনানন্দের প্রাকৃতিক ও পারিবারিক পরিবেশ’ শিরোনামে যে নিবন্ধ লেখেন, সেখানেও ওই একই তথ্য রয়েছে যে, জীবনানন্দ দাশ বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
যদিও ১৮ নাকি ১৭ ফেব্রুয়ারি তা নিয়েও বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু প্রভাতকুমার দাস লিখেছেন, তিনি নানাভাবে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখটির ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়েছেন। আবার জন্মসাল হিসেবেও ১৮৯৯-এর পক্ষে মত বেশি। জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের সঙ্গে মোটাদাগে কোনো দ্বিমত নেই, যেটি ইদানীং কেউ কেউ পোষণের চেষ্টা করছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের একটি রিপোর্টেও জীবনানন্দের জন্মস্থান ঝালকাঠি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। যদিও সেখানে ঐতিহাসিক কোনো তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ ছিল না।
আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং আবুল হাসনাত সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থেও তাঁর জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে আরো যেসব লেখক জীবনানন্দের জন্মবৃত্তান্ত লিখেছেন, তাঁরা সবাই জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে মার্কিন গবেষক ক্লিনটন বি সিলি তাঁর ‘অনন্য জীবনানন্দ’ গ্রন্থেও তাঁর জন্মস্থান হিসেবে বরিশালের কথা উল্লেখ করেছেন।
কারো কারো এরকম দ্বিধা হওয়া অসম্ভব নয় যে, জীবনানন্দ যখন জন্মেছেন তখন আলাদা করে ঝালকাঠি কোনো জেলা শহর ছিল না। বরং এটি ছিল বরিশালেরই অংশ। ফলে জীবনানন্দের জন্মস্থান হিসেবে বৃহত্তর অর্থে বরিশাল লেখা হলেও কার্যত তাঁর জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামেই। কিন্তু এই যুক্তিও ধোপে টেকে না যেখানে জীবনানন্দ নিজে এবং তাঁর আপন ছোট ভাইও লিখেছেন তাঁর জন্ম বরিশাল শহরে।
ফলে যাঁরা এখন তাঁর জন্ম ঝালকাঠির বামনকাঠি গ্রামে বলে দাবি করেন এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাঁদের দাবির সপক্ষে শক্ত কী তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, সেটি দেখার বিষয়। কিন্তু যে সত্যটি এত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, ১১৭ বছর পরে তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিয়ে আখেরে কী ফল হবে, তা আন্দাজ করা কঠিন।
তবে সম্প্রতি ঝালকাঠি শহরের অদূরে বামনকাঠি এলাকায় জীবনানন্দের নামে একটি সড়কের উদ্বোধন করা হয়েছে। তাঁর নামে বিশ্বের যেকোনো জায়গায়ই সড়ক হতে পারে, কিন্তু যদি এটা দাবি করা হয় যে, ওই এলাকায় জীবনানন্দ জন্মেছিলেন, সেটি বিভ্রান্তির জন্ম দেয় এবং এটা ইতিহাসকেও চ্যালেঞ্জ করে। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত অনেকেই বিশ্বাস করেন এবং দাবি করেন যে, জীবনানন্দের জন্মস্থান ঝালকাঠিতে। কিন্তু তাঁদের এই দাবির সপক্ষে কী জোরালো তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তাঁদের উচিত হবে এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ হাজির করা এবং বইয়ের পাতায় যেসব তথ্য এখন আছে, সেগুলো ভুল প্রমাণ করা। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ না থাকলে জীবনানন্দের মতো একজন কালজয়ী কবি ও লেখকের জন্মস্থান নিয়ে অহেতুক বিতর্ক থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।