প্রেমের দেবীকে নিয়ে সাফোর কবিতা
সমালোচকদের বিবেচনায় সাফো (৬৩০-৫৭০ খ্রীষ্টপূর্ব) বিশ্বের প্রথম নারী কবি। কিন্তু তাকে বিচার করার এটিই প্রধান বিষয় নয়। বরং কবি হিসাবেই সাফো বিশ্ব কবিতায় এক বিশাল ব্যতিক্রম ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর হিসাবে বিবেচ্য। গ্রীসের লেসবস দ্বীপে তার জন্ম। লেসবস সে সময় গ্রীসের জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র ছিলো। লেসবস দ্বীপের অধিবাসীদের লেসবিয়ান বলা হয়। সাফো’র কারণেই পরবর্তীতে লেসবিয়ান শব্দটির ভিন্ন মানে দাঁড়ায়। নারী সমকামীকে লেসবিয়ান বলা হয়। সাফো তাই ছিলেন বলে অনেকের ধারণা। তার কবিতাতেও নারীর প্রতি তীব্র প্রেম ও কামনা লক্ষ করা যায়।
সাফোকে সমকামী হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও সেটাই শেষ কথা নয়। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কও আছে। তর্কের সুবাদে অনেকেই বলেন, সাফো যেমন নারী সঙ্গ পছন্দ করতেন তেমনি সক্রেটিসও পুরুষ সঙ্গ পছন্দ করতেন। তাহলে সাফো লেসবিয়ান হলে সক্রেটিস কি সমকামী? আসলে কাব্যে এবং প্রেমের কবিতার সকল ক্ষেত্রেই যৌনতাই একমাত্র ব্যখ্যা নয়। অন্যদিকে, ফাউন বলে এক নৌকার মাঝি’র কথা সাফোর প্রেমের কবিতায় আছে। ধারণা করা হয় এই মাঝি’র সঙ্গেও তার প্রেম ছিলো। তাই সাফোর সকল প্রেমই যে সমলৈঙ্গিক কামনা তা নয়।
কবিতা লেখার পাশাপাশি সাফো শিক্ষকতা করতেন। অবিবাহিত মেয়েদের নিয়ে থিয়াসস নামে তার একটি বিশেষ স্কুল ছিলেন। ধারণা করা হয়, প্লেটো-সক্রেটিসের মতো তিনি শিষ্যকূলদের কাব্য, দর্শন ইত্যাদির শিক্ষা দিতেন। অবিবাহিত মেয়েরা এখানে সাফোর কাছে প্রেম, বিয়ে ও জীবনের নানা শিক্ষা পেতেন। এরমধ্যে কারো কারো সাথে তার আন্তরিক সম্পর্ক হয়ে যায়। সাফোর এই কুমারী নারী সমাজ যথাযথ কারণেই অনেকে মেনে নিতে পারেনি। নানা ধরণের অভিযোগ ওঠে তাকে ও এবং ছাত্রীদের ঘিরে।
গিরিন্না, আত্তিস, এনাক্টরিয়া প্রমুখ নারীকে নিয়ে তার প্রসঙ্গে নানা মতামত পাওয়া যায়। অবশেষে তাকে লেসবস থেকে নির্বাসিতও করা হয়।
কিন্তু ব্যক্তি সাফোকে নিয়ে যতো কথাই থাকুক তার কবিতা নিয়ে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম নারী কবিই শুধু নয়, প্রেমের কবিতার ইহিতাসে তিনি অগ্রগণ্য কবি। তার কবিতা আজকের সময়েও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাফোর অধিকাংশ কবিতাই হারিয়ে গেছে। অনেক কবিতাই আবার আংশিক পাওয়া যায়। বহু কবিতার একটা দুটা পংক্তি বা লাইন মাত্র পাওয়া যায়। অথচ সাফো প্রচুর লিখেছেন বলে জানা যায়। অন্তত কয়েক হাজার কবিতা তিনি লিখেছেন। কিন্তু তার খুব কম অংশই ইতিহাসের গর্ভ থেকে উদ্ধার করা গেছে। বলা হয়ে থাকে, ১৪১ খ্রিস্টাব্দে এবং ১০৭৩ খ্রিস্টাব্দে পরপর দুইবার চার্চের আদেশে সাফোর অনেক কবিতা ধ্বংস করা হয়েছে। তার কবিতার তীব্র যৌনতাই এর কারণ ছিলো। একমাত্র আফ্রোদিতির প্রতি গাথা (Ode to Aphrodite) কবিতাটি পূর্ণাঙ্গ আকারে পাওয়া যায়।
সাফো বরাবরই ভক্ত ছিলেন আফ্রোদিতির। গ্রীকদের সৌন্দর্য, আনন্দ, প্রেম আর প্রজননের আদিম দেবী আফ্রোদিতি। রোমানরা তাকে ভেনাস নামেই ডাকেন। সাফোর কোন কোন কবিতায় তাকে সাইপ্রিয়ান বলা হয়েছে। কারণ পুরাণ অনুযায়ী আফ্রোদিতির জন্ম সাইপ্রাস দ্বীপে। এখানে আফ্রোদিতিকে নিয়ে লেখা সাফোর কিছু কবিতা দেয়া হলো। প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিই তার কবিতার অন্যতম প্রেরণা। এই দেবীর প্রতি তার একনিষ্ঠ প্রেমও নারী প্রেমের একাধিক কবিতা লিখতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে হয়তো বা।
সাফোর কবিতা গীতধর্মী। তিনি লায়ার নামে এক গ্রীক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এই কবিতাগুলো সুর করে পড়তেন বা গাইতেন। বলা হয়ে থাকে সাফো যে লায়ার বাজিয়ে গান গাইতেন পরবর্তীতে খুৎরপ বা গীতিকবিতা শব্দটি এই লায়ার শব্দ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। প্রাচীন সমালোচরা বলেছেন, সাফো গীতিকবিতার পাশাপাশি শোকগাঁথা এবং আয়াম্বিক ছন্দের কবিতাও লিখতেন। কিন্তু সেগুলো আর পাওয়া যায় না। অন্যদিকে পরবর্তীকালে সাফোকে অনুসরণ করে অনেকে কবিতা লিখেছেন, যা সাফোর নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। সাফোর কবিতা যথার্থই ব্যতিক্রমধর্মী। তার কবিতা পরবর্তীকালের বহু বড় কবিদের অনুপ্রাণিত করেছেন। রোমান কবি কাতাল্লুস সাফোর বহু কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রণ সাফোকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বায়রন ছাড়াও শেলি, টেনিসনের মতো কবিরাও সাফোর কবিতা অনুবাদ করেছেন এবং প্রভাবিত হয়েছেন তার কবিতা দ্বারা। সাফোর কবিতার তীব্র প্রেম, ইন্দ্রিয়জ কামনা ও যৌনতা আধুনিক কবিতায় প্রভাব ফেলেছে। পুরুষতান্ত্রিক কাব্যচর্চার বিরুদ্ধেও সাফোর কবিতা ভিন্ন স্বর হিসাবে আলোচিত। তার কবিতা মূলতই প্রেম ও ব্যক্তি সম্পর্ক নির্ভর। তবু সাফোর কবিতায় ইতিহাস, পুরাণ এমনকি সমকালও ঠাঁই পেয়েছে প্রেমের আড়ালেই।
সাফোর কবিতা ভাষা সরল, কিন্তু ইঙ্গিপূর্ণ। শব্দ নির্বাচনে তিনি সাহসী। তার একাধিক কবিতায় কৌতুকের ইঙ্গিতও আছে। দুঃখ-বেদনা নিয়েও তিনি মজা করতে ছাড়েন না। তীব্র প্রেমের জ্বালা ও দেহজ কামনা ঘিরে তার কবিতা এক ধরণের আবেশ তৈরি করে। আফ্রোদিতি নারী হওয়ায় সাফোর প্রেমও সমলৈঙ্গিক হয়ে থাকতে পারে। প্রকৃতিও তার কবিতায় একটা বড় অংশ দখল করে আছে। জ্যোৎস্না ও চাঁদের অনুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন তিনি একাধিক কবিতায়।
সাফোর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। পিতা-মাতার নাম না-জানা গেলেও এটা নিশ্চিত যে তিনি লেসবসের এক ধনী পরিবারের কন্যা ছিলেন। ২০১৪ সালে ‘ব্রাদার্স পোয়েম’ নামে তার একটি কবিতা আবিস্কৃত হয়, যেখানে তার দুই ভাইয়ের নাম আছে। অনেকের মতে, তার তিন ভাই ছিলো। ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাকে সিসিলিতে নির্বাসন দেয়া হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (৫৭০ খ্র:পূ) পর্যন্ত সেখানে থেকেই তিনি লিখতে থাকেন। তার স্বামী সারকাইলাস বিত্তবান ছিলেন। সাফো অভিজাত ও ঐশ্বর্যময় জীবন যাপন করতেন। নীল নয়না সাফো দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলেন। সাফোর একটি কন্যা সন্তান ছিলো, যার নাম ক্লেস। অনেকের মতে সাফোর মা’র নামও ক্লেস ছিলো।
হাজার হাজার বছর পার হয়ে গেছে, সাফোর কবিতার উপরে অনেক আঘাত এসেছে। তবু যতোটুকু টিকে আছে তাই নিয়ে আজও সাফো বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা একজন কবি।
প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিকে নিয়ে সাফোর কয়েকটি কবিতা পাঠ করা যেতে পারে ভালোবাসা দিবসে।
আমি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি
আমি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি
কি, সাফো, পারবে
তেমন কাউকে কিছু দিতে
যার সবকিছু আছে,
আফ্রোদিতির মতো?
তোমার গঠন মনোরম
তোমার গঠন মনোরম আর তোমার চোখ মধুময়
তোমার মুখের উপর ভালোবাসার
হালকা স্বচ্ছ আলো ঘোমটার মতো এসে পড়ে।
তুমি জেগে ওঠো
প্রসারিত হাতে,
তোমার সম্মুখে আফ্রোদিতি দাঁড়ানো।
আফ্রোদিতির দোষ
প্রিয় আম্মাজান,
কোন লাভ নাই
আমি শেষ করতে পারি নাই
বুনন কাজ
তুমি বরং
আফ্রোদিতিকে দোষ দাও
সে বড় কোমল
কিন্তু সে আমায় প্রায় মেরে ফেলেছে
সেই ছেলেটির ভালোবাসার টানে
ভালোবাসা
মিষ্টি মা গো, অলস তাঁতের পানে আমি ঝুঁকে থাকি
আকাঙ্ক্ষায় পরিশ্রান্ত হয়ে সেই বালকের জন্যে
যে এখনও এক সুন্দরের স্বপ্ন হয়ে আছে— ভরে আছে
আমার আত্মায়, জীবনে, আফ্রোদিতি ইচ্ছায়।
আফ্রোদিতির প্রতি গাথা
চমকপ্রদ মনের মৃত্যুহীন আফ্রোদিতি,
আমি অনুনয় করি, জিউসের কন্যা, ফাঁদ বুননকারী
আমার হৃদয় বিচূর্ণ কোরো না প্রচন্ড
বেদনায়, দেবী আমার।
তবে এসো এখন, যদি কখনো কোনদিন
তুমি আমার কণ্ঠ শুনে থাকো, দূর থেকে, এবং শুনেছিলে,
ছেড়ে এসো তোমার পিতার স্বর্ণগৃহ,
এবং এসেছিলে।
বাঁধো তোমার রথ। মনোরম দ্রুত
চড়ুই যারা তোমাকে বহন করে কৃষ্ণ ভূবনে
ঘুর্ণায়মান পাখা বাতাস ছিঁড়ে
আকাশের নিচে আনে।
তারা এসেছিলো। আর তুমি, পূণ্যনারী,
মৃত্যুহীন মুখে হেসেছিলে, জানতে চেয়েছিলো
এখন কী, যখন আমি ভূগছি: কেন এখন
আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলাম, আবার :
এখন কি আমি কামনা করি সব কিছুর উপর আমার
উন্মাদ হৃদয়ে। ‘এখন কাকে চাও, আমি কি প্ররোচিত
করবো তাকে যেন তোমাকেই ভালোবাসে সে ,
সাফো, এখন কে তোমায় বিপর্যস্ত করে?
যদি সে এখন ছুটে আসে সে পরে তোমাকেই অনুসরণ করবে
যদি উপহার প্রত্যাখান করে থাকে সে তবে তোমাকেই উপহার দেবে
যদি সে এখন ভালো-না-বাসে শীঘ্রই ভালোবাসবে
তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও ভালোবাসবে।’
আমার কাছে আসো এখন, তারপর, মুক্ত করো আমাকে
এই বেদনার তদারকি থেকে, আর আমাকে জয় করো
আমার সকল হৃদয় জয়ের আকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ। তুমি,
বন্ধু হও আমার।