জীবাণুবাহিত হেপাটাইটিস (জন্ডিস) প্রতিকারে
যকৃত বা লিভারের প্রদাহকে আমরা হেপাটাইটিস বলি। এই হেপাটাইটিস যখন কোনো জীবাণু বা ভাইরাসের সংক্রমণে হয়, তখন একে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলা হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ হলেও অনেক ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। আজ শনিবার (৩১.০১.২০১৫ তারিখ) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৩২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের যকৃত বিভাগের পরামর্শক এবং যকৃত বিশেষজ্ঞ ডা. ফাওয়াজ হোসাইন শুভ।
প্রশ্ন : ভাইরাল হেপাটাইটিস মানে কী? সাধারণত কোন কোন জীবাণুর মাধ্যমে এটি হয়?
উত্তর : যকৃতের প্রদাহকে হেপাটাইটিস বলা হয়। এটা কোনো জীবাণুর মাধ্যমে হলে ভাইরাল হেপাটাইাটিস বলা হয়। সাধারণত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই-এই পাঁচটি জীবাণুর মাধ্যমে এই রোগ হয়ে থাকে। তবে আরো কিছু অজানা জীবাণু রয়েছে যেগেুলোর মাধ্যমেও এই ভাইরাল হেপাটাইটিস হতে পারে।
প্রশ্ন : এর মধ্যে কোন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে লিভার বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে বা কোন জীবাণুটি গুরুতর?
উত্তর : হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি গুরুতর। কারণ এই ভাইরাসের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর খারাপ দিকে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।
প্রশ্ন : মৃত্যুর ঝুঁকি আছে কি?
উত্তর : এই সমস্যা থেকে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। হেপাটাইটিস-বি জীবাণুর মাধ্যমে যদি লিভারে প্রদাহ বা হেপাটাইটিস হয়, তাহলে সেটি দুই রকমের হতে পারে। একটি হচ্ছে একিউট হেপাটাইটিস, যেটি ছয় মাসের কম সময় থাকে। আরেকটি ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, যেটি ছয় মাসের বেশি সময় থাকে। এই ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ভাইরাস থেকে যকৃতের সিরোসিস, যকৃতের কর্মক্ষমতা নষ্ট অথবা যকৃতের ক্যানসারও হতে পারে।
তেমনিভাবে সি ভাইরাসের ক্ষেত্রেও লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি হয়ে থাকে। এই কারণে বর্তমানে চিকিৎসকরা হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
প্রশ্ন : একজন ব্যক্তি এসব ভাইরাসের মাধ্যমে কীভাবে আক্রান্ত হতে পারে?
উত্তর : অবাধে যৌনাচার, একই সিরিঞ্জ যদি সবাই ব্যবহার করে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যদি পরীক্ষা না করে অন্য ব্যক্তিকে দেওয়া হয়ে, সন্তানসম্ভবা মায়ের যদি হেপাটাইটিস বি থাকে তাহলে নবজাতক আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া টুথব্রাশ, রেজার এসব জিনিস একজনেরটা অন্যজন ব্যবহার করলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : এই রোগের লক্ষণ কী?
উত্তর : যদি কোনো ব্যক্তি ক্রনিক হেপাটাইটিস বি বা সি জীবাণুর মাধ্যমে আক্রান্ত হয় তবে লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে তার যকৃত এনজাইমগুলো বেশি থাকতে পারে। সাধারণত যকৃত এনজাইম যদি বেশি থাকে তাহলে হেপাটাইটিস বি ও সি জীবাণুর পরীক্ষা করা হয়।
এ ছাড়া একিউট ভাইরাসের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়ে থাকলে জণ্ডিসের সেসব লক্ষণ আছে, যেমন চোখ হলুদ হওয়া, প্রস্রাব হলুদ হওয়া, শরীরে চুলকানো, বমি বমি ভাব- এসব হতে পারে।
প্রশ্ন : যাদের ক্রনিক ভাইরাস রয়েছে অর্থাৎ যাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ বোঝা যায় না তারা কীভাবে বুঝবে তারা এই রোগে আক্রান্ত?
উত্তর : এখন মানুষ অনেক সচেতন। তাঁরা নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে যান। তাঁদের ক্ষেত্রে যদি লিভার এনজাইম বেশি দেখা যায় তবে হেপাটাইটিস বি বা সি-এর টেস্ট করানো হয়। তখন অনেকেরই রোগটি ধরা পড়ে- এটি হচ্ছে একটি উপায়।
কেউ রক্ত দিতে গেলে তখন যেসব টেস্ট করা হয় সেখান থেকেও এই রোগ ধরা পড়তে পারে।
বিদেশে যাওয়ার সময় এসব জীবাণুর পরীক্ষা হয়ে থাকে তখনো কেউ আক্রান্ত কি না সেটি বোঝা যাবে। এছাড়া যদি কারো সার্জারি করা হয় তার আগেও শরীরে বি এবং সি জীবাণু আছে কি না দেখে নেওয়া হয়।
প্রশ্ন: কেউ যদি হেপাটাইটিসে আক্রান্ত না হয় কিন্তু সে জানে বি ও সি ভাইরাসের ক্যারিয়ার তখন কী করবে?
উত্তর : বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা কিছু পরীক্ষা করি। এই পরীক্ষার দুটো উদ্দেশ্য থাকে। একটি, জীবাণুটি সক্রিয় না নিষ্ক্রিয় সেটি দেখা। আরেকটি জীবাণুটি যকৃতের কতটুকু ক্ষতি করেছে এবং বর্তমানে যকৃতের অবস্থান কীরকম। এ ক্ষেত্রে এইজ বি ই এজি, এন্টি এইজ বি ই পরীক্ষা করা হয়।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা, তার সঙ্গে আলট্রাসোনোগ্রাম করে যকৃতের অবস্থান দেখা হয়। তারপর যদি জীবাণু সক্রিয় থাকে বা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি থাকে, তখন চিকিৎসা দেওয়া হয়।
চিকিৎসার জন্য বি ভাইরাসের ক্ষেত্রে ওরাল অ্যান্টি ভাইরাল, ইন্টার ফেরোর ইনজেকশনস দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ডিএনএ নিষ্ক্রিয় করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে এপেক ইন্টার ফেরোন ব্যবহারে জীবাণু ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যায়।
সি-এর ক্ষেত্রে আরএনএ এবং জেনোটাইপ পরীক্ষা করে দেখা হয় কোন ধরনের সি জীবাণুর মাধ্যমে আক্রান্ত। পাশাপাশি আলট্রাসনোগ্রাম করে যকৃত কমপানসেটেট নাকি ডিকমপানসেটেট অবস্থায় রয়েছে সেটি দেখা হয়। তখন পেগ ইন্টার ফেরোন ,রিরাভেরিনসহ আরো কিছু ট্রিপল থেরাপি দেওয়া হয়।
কমপানসেটিভ অবস্থায় চিকিৎসা করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আর ডিকমপানসেটিভ হলে অর্থাৎ যদি পেটে পানি চলে আসে, গলার রক্তনালি বড় হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা না দিয়ে লক্ষণ অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা দেওয়া হয়। তবে এ অবস্থায় রোগটি অনেক জটিল পর্যায়ে চলে যায়।