ক্রিকেট
অন্য এক মুশফিককে দেখল বাংলাদেশ
জয়ের খরায় ভুগতে থাকা বাংলাদেশ আবিষ্কারর করল ক্ষুধার্ত এক ক্রিকেটারকে। সত্যিই তিনি ক্ষুধার্ত। রানের ক্ষুধা তাঁর। ম্যাচ জেতার ক্ষুধা তাঁর। ক্ষুধা তাড়িত ছোটখাটো সেই ক্রিকেটারের ক্ষুধা আরো প্রবল হচ্ছিল প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কিছু আপমানে। চাপ প্রয়োগে।
হ্যাঁ, আপমান। টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কের নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া হলো! হাতের গ্লাভস জোড়া খুলে রাখতে বলা হলো! সরিয়ে দেওয়া হলো উইকেটের পেছন থেকে এবং কাজগুলো যেভাবে করা হলো তা দেখে মনে হতেই পারে, সাফল্য খরার চেয়ে বেশি ভুগছে বাংলাদেশ তার ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষে!
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয়ের খরাটা প্রকট হয়ে দেখা দিল। কিন্তু ক্রিকেট সংস্কৃতির সঞ্চালনের নালিটা যে শুকিয়ে যাচ্ছে, সেটা বোঝা কঠিন ছিল। সিনিয়ররা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ‘অচল’ এ রকম একটা আওয়াজ তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ দলের বিগ ব্রাদারে পরিণত হওয়া এক অধিনায়ককে হঠাৎ অবসরের ঘোষণা দিতে হলো! অন্য সিনিয়ররাও খুব স্বস্তিতে দলে ছিলেন তাও নয়। অস্বস্তির জায়গাটা কী ভয়াবহ ছিল, তা বুঝতে খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শ্রীলংকার বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজেই ছয়-ছয় জন ক্রিকেটারের অভিষেক হলো! এক ম্যাচ খেলে পরের ম্যাচে ছিটকে গেলেন অনেকে! আবার আস্থা রাখতে হলো সেই অভিজ্ঞদের ওপর। সিনিয়র-জুনিয়রদের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে অন্য রকম চাপের বাতাবরণ তৈরি করা হলো। এমন পরিস্থতিতে সামর্থ্য থাকলেও নিজেকে প্রমাণ করার কাজটা কঠিন হয়ে যায়।
কিন্তু সেই কঠিন কাজটা একজন এমন ভাবে করলেন যাতে খানিকটা বিস্মিত হতে হয়। স্তম্ভিত হতে হয়। ত্রিশোর্ধ মুশফিক নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে যে ইনিংসটা খেলেছেন সেটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর সেরা ইনিংস। নিজেও স্বীকার করেছেন। কিন্তু এরচেয়ে ভালো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান কবে খেলছেন? এভাবে কবে কোন বাংলাদেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জিতিয়েছেন? ৩৫ বলে অপরাজিত ৭২ রান! টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে অবশ্য এর চেয়ে অনেক আগ্রাসী এবং বড় ইনিংস অনেকেই খেলেছেন।কিন্তু উপমহাদেশের কোনো দলই তো এখনো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২১৪ রান তাড়া করে জেতেনি। মুশির ব্যাটের সৌজন্যে বাংলাদেশ সেই কাজটাই করে দেখিয়েছে! নিজেকে প্রমাণ করার এরচেয়ে ভালো মঞ্চও বোধহয় মুশফিকের জন্য আর ছিল না।
অপমানের জবাব দেওয়ার জন্য কোনো ব্যাটসম্যানের হাতে ব্যাট ছাড়া ভালো আর কী আছে? মুশফিকের হাতেও তাই। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বাড়তি মোটিভেশন দরকার পড়ে। আর তার বড় উপদান ক্রিকেট নামক খেলাটার প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা। বাড়তি অনুশীলন সেটাও খেলাটার প্রতি ভালোবাসা থেকে উৎসারিত হয়। কিন্তু মুশফিকের সেই ভালোবাসা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ হিসেবে বেরিয়ে পড়ল কলম্বোতে লংকানদের হারানোর পর। তাঁর ‘নাগিনী নাচ’! এখন ক্রিকেট মিডিয়া থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। এই নাচের কয়েক সেকেন্ড সময়ে তাঁর শরীরিক ভাষা যা বলছিল, তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা হতে পারে। আসল ব্যাখ্যাটা শুধু মুশফিকের মনই জানে। কোন নাগিনীর কোন ছোবলে তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেটা অবশ্য অদৃশ্য ক্ষরণ। সেই রিপোর্ট হয়তো পাওয়া যাবে কোনো একদিন মুশির আত্মজীবনীতে।
আত্মজীবনী সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। দিন দুয়েক আগের অতীত বলে দিয়ে গেল বড় ক্রিকেটাররা শুধু বয়সের সাথে লড়াই করেন না। তাঁদের লড়াইটা শুধু সমালোচনার সাথে নয়। তাদের সবচেয়ে বড় লড়াই নিজেকে প্রমাণ করার। ক্যারিয়ারজুড়ে সেই লড়াইটা নিরন্তর। মুশফিকের ৩৫ বলে অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংসটা নিছক সংখ্যাজাত। কিন্তু ওই ম্যাচে অত্যন্ত সচেতনভাবে এক ইনিংস খেললেন, যাতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সাফল্যের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ আবিষ্কার করল, তার চৌচির হয়ে পড়া ক্রিকেটীয় জমিনে সাফল্যের সবুজ আভা ছড়ানোর রসদ আছে। যতই তাঁর এবং তাঁদের বয়স ত্রিশোর্ধ বা ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। এখনো তাঁরা উন্মুখ নিজেদের প্রমাণ করতে। দলকে সাফল্য এনে দিতে। ক্রিজে এসে এখনো তাঁরা স্কোরবোর্ডের দিকে তাকান দলের জয়ের কথা মাথায় রেখে। এখনো প্রতিপক্ষের চোখের দিকে চোখ রেখে লড়াই করার ক্ষমতা আছে তাঁদের। নিজেদের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করার সময় হলে তাঁরা নিজেরাই সরে যাবেন। নিজেদের অহংকে প্রতিষ্ঠিত করতে অহেতুক মুশফিকদের ওপর চাপ তৈরি না করাই ভালো। তাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মঙ্গল হবে।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট