বজ্রপাতে অসহায় হাওরের কৃষক, আতঙ্কে কাটছে দিন
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে গত দুই মাসে মারা গেছেন ১১ জন। কয়েক বছরে হাওরে হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় বৃষ্টির সময় বজ্রপাত আতঙ্কে হাওরে যেতে চান না কৃষক। আকাশে মেঘ দেখলেই কাজ ফেলে বাড়ি ফিরে আসছেন।
অথচ এ সময় হাওরে ধান কাটার কাজ চলে। চলে ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষককে কাটাতে হয় খোলা প্রান্তরে। অথচ বজ্রপাত আতঙ্কে অসহায় হয়ে পড়ছেন হাওরের কৃষকরা।
মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষনায় দেখা গেছে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। প্রতি বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে বোরো ধান কাটতে হাওরে বেশি সংখ্যক মানুষ থাকায় এই হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে।
মূলত মার্চ মাসের শেষের দিকে হাওরে বোরো ধান পাকতে শুরু করে। তখন হাওরের খোলা প্রান্তরে কৃষকরা কর্মব্যস্ত সময় কাটায়। হাওরে হাওরে চলে ধান কাটা, পরে চলে সেই ধান মাড়াই আর শুকানোর কাজ। কৃষকেরা সকাল থেকে অন্ধকার নামার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই পার করেন হাওরের খোলা জায়গায়। তখন ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টিপাত শুরু হয় সঙ্গে চলে বজ্রপাত।
বজ্রপাতে কেবল মানুষ মারা যায় তা না, হাওরে থাকা গবাদি পশুও বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে।
শুক্রবার সকালেও তাহিরপুর উপজেলরা বরহাটি গ্রামের জাফর মিয়া (৪১) নামের একজন মারা যান। গত পাঁচদিনে সুনামগঞ্জ সদরে দুইজন, জামালগঞ্জে একই দিনে দুই জন বিশ্বম্ভরপুরে একজন এবং তাহিরপুরে একজন ,দক্ষিন সুনামগঞ্জে একজন সহ বজ্রপাতে মোট সাতজনের মৃত্যু হয়েছে আহত হয়েছেন আরো ১০জন। হাওরে ধান কাটতে গিয়ে এই সব হতাহতের ঘটনা ঘটে।
‘হাওরে না গেলে খাবার জোটে না’
সব কিছু জেনেও শুধু পেটের তাগিদে নিরুপায় হয়েই মাঠে নামেন কৃষক। হাওরের কৃষক আবদুল মমিন (৩২) জানান, গত বছর তাঁর পাশেই বজ্রপাতে লুটিয়ে পড়েন এক কৃষক। তারপরও কিছু করার নেই। তিনি বলেন, ‘হাওরে না গেলে কাজ করা হয় না। কাজ না হলে খাবার জোটে না। সেই ছোটবেলা থেকে বাবার হাত ধরে হাওরে গেছি কখনো মাছ ধরতে কখনো ধান কাটতে। জীবন আমার এভাবেই কেটে যাচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ জয়কলস গ্রামের শাহ আলম( ৪০) জানান, তীব্র শীতেও হাওরে কাজ করা যায়, তুফান হলেও কাজ করা যায় কিন্তু বজ্রপাত শুরু হলে এখন আর কাজ করা যায় না। কারণ বজ্রপাত হলেই মানুষ মারা যায়। তিনি বলেন, ‘হাওরের সব খানেই খোলা জায়গা, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে কোথাও গিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই, এমনও হয়েছে বজ্রপাত শুরু হলে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসার সময়ও অনেকে বজ্রপাতে মারা গেছেন। তাই জানে ভয় চলে এসেছে। চাইলেও কাজ করা যায় না।’
সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের রাসেল মিয়া বলেন, ‘আমরা মাঠে কাজ করছিলাম মঙ্গলবার সকালে বৃষ্টির সাথে বজ্রপাত শুরু হলে হাসেম ভাই মারা যান। এই মৃত্যু দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেছি। তাই এখন বৃষ্টির সময় বজ্রপাত ভয়ে মাঠে যাই না। শুধু আমি না আমাদের এলাকার কেউই মাঠে কাজ করতে যান না।’
শরিফা বানু (৫৫) বলেন, ‘আপনাদের মতো ভয় পেলে চলবে না, আমাদের কাজ করতে হবে, মাঠে যেতে হবে। রোদ-বৃষ্টি এলে কী করব। সবই আমাদের কাছে সমান। আমরা ভয় পাই না। আমরা বুঝি কাজ না করলে খাওন নাই।’
‘প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের মতামত’
সুনামগঞ্জ -৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘দ্রুত আবহাওয়া ও বজ্রপাত বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কারণ বজ্রপাত হলেই সুনামগঞ্জে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। দ্রুত পদক্ষেপ দিয়ে সমাধান করা দরকার লাগবে। এই জনপদের মানুষ জীবিকার তাগিদেই হাওরে কাজ করতে নামেন। তাই বজ্রপাতের সময় হাওরে থাকলে মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে দ্রুত সমাধান করা দরকার।’
জেলা ত্রাণ অফিসের দেয়া তথ্যমতে ২০১৫ সালে বজ্রপাতে মারা যাওয়া ৪২ জনকে, ২০১৬ সালে ১৮জন এবং ২০১৭ সালে তিনজনকে নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে হাওর থাকায় এখানকার জীবন জীবিকা হাওর নির্ভর। জেলার ১১উপজেলার ১৫৪টি ছোটবড় হাওরে বোরো ধানের চাষ করা হয়। আর মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রায় সব হাওরেই ধান কাটার ধুম পড়ে।
ধান কাটা শেষ হলে বৃষ্টির পানিতে নদী ও হাওর ডুবে থাকে তখন সেখানে প্রায় সারা দিনই মাছ ধরেন জেলেরা। তখনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মূলত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যখন বৃষ্টিপাত শুরু হয় তখন থেকে শুরু করে অক্টোবর বৃষ্টিপাতের সময়ে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে।
এ ব্যাপারে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘আমরা এর আগে এতো বজ্রপাত আর বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা দেখিনি। গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মানুষ বেশী মারা যাচ্ছে। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন মিলে দ্রত সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষকে বাঁচাকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, ‘হাওর এলাকায় বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। গত তিন আগে সব উপজেলায় যেকোন ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সভা করা হয়েছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেইজে সচেতনতা মূলক লেখা পোস্ট করা হয়েছে। সেই সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে হাওরে বজ্রপাতের সময় করণীয় সম্পর্কে অবগত করছেন।’
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানদেরও এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে পরামর্শ দেওয়া নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। হাওর এলাকার দ্রুত ধান কেটে নিতে বালু ও পাথর শ্রমিকদের বালু এবং পাথর বন্ধ রেখে ধান কাটতে উব্ধুদ্ধ করা হয়েছে। হাওরের যেসব স্থানে বড় গাছ আছে সেখানে বজ্রপাত নিরোধক ধাতব বস্তু লাগানো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে হাওর এলাকায় বজ্রপাত কমাতে কমাতে দীর্ঘ মেয়াদ পরিকল্পনা অংশ হিসেবে ৩০হাজার তালগাছ রোপন করা হয়েছে।’