ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণ ও করণীয়
ফুসফুস ক্যান্সারের প্রধান কারণ তামাক গ্রহণ। প্রতিদিন যারা দুই থেকে তিন প্যাকেট সিগারেট সেবন করেন এবং ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে সেবন করেন, এদের মধ্যে ৯০ ভাগ লোকের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আজ শুক্রবার (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৪৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক অধ্যাপক ডাক্তার সৈয়দ মোহম্মদ আকরাম হোসেন।
প্রশ্ন : ফুসফুস ক্যান্সারের উপসর্গ কী?
উত্তর : ফুসফুসের ক্যান্সারের অনেক লক্ষণ রয়েছে। যদি টিউমারের আকার ছোট হয় তাহলে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। যদি টিউমারের পরিমাপ বড় হয় তখন লক্ষণ দেখা যায়। তখন কাশি থাকে এবং কাশির সঙ্গে রক্ত ঝরে। এ ছাড়া শরীরের ওজন কমে আসে, গলার স্বর ভেঙে যায়।
প্রশ্ন : কারো যদি ফুসফুসে ক্যান্সার হয় তবে কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
উত্তর : যখন টিউমারটি ছোট থাকে, সুস্থ হওয়ার মতো, তখন সে ক্ষেত্রে সমস্যা ধরা পড়ে না। কোনো টিউমার যদি পাশে থাকে সে ক্ষেত্রেও বোঝা যায় না। এটি আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। যারা ২০ থেকে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ধূমপান করে তারা যদি এক্সরে করে বা স্ক্রিনিং করে তাহলে অনেক সময় সমস্যা ধরা পড়ে। এ রকম করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৫ ভাগ রোগীকে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
প্রশ্ন : যখন এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে তখন কী কী পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং আপনাদের চিকিৎসা পদ্ধতিটি কীভাবে শুরু করেন?
উত্তর : সাধারণত প্রথম দিকে চিকিৎসকের কাছে যখন এই সমস্যাগুলো নিয়ে আসেন তখন ফাইনিরিলিস স্পিডিশন সাইটোলজি করতে বলা হয় এবং সিটি গাইটেট করা হয়। এগুলো করলে আমরা জানতে পারি কোন ধরনের ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ব্যক্তিটি। পরবর্তী সময়ে দেখা হয় এটি অন্য কোথাও ছড়িয়েছে কি না। সে ক্ষেত্রে আল্ট্রাসনোগ্রাম, বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা এবং হাড় পরীক্ষা করা হয়। যদি না ছড়িয়ে থাকে তাহলে এক রকমের চিকিৎসা এবং ছড়িয়ে থাকলে আরেক ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এতে আবার কোষের ভিন্নতা রয়েছে। একটাকে বলা হয় স্মোলসার ফুসফুস ক্যান্সার। আরেকটিকে বলা হয়, স্কোয়ামাস ফুসফুস ক্যান্সার।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে কী ধরনের চিকিৎসা করা হয়?
উত্তর : প্রথম দিকে ছোট থাকলে অপারেশন করা হয়। বড় হলে রেডিও থেরাপি কেমোথেরাপি করে চিকিৎসা করে থাকি।
প্রশ্ন : অনেকেরই এ সময় মানসিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এ সময় কীভাবে রোগীকে তার মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়? পাশাপাশি চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে আপনাদের পরামর্শ কী হয়?
উত্তর : এটাকে আমরা ব্রেকিং দি বেড নিউজ বলে থাকি। খারাপ সংবাদ মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি পদ্ধতি থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা তথ্যটি রোগী এবং তার আত্মীয়দের কাছে ধীরে ধীরে পৌঁছাই। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে আমরা জানানোর চেষ্টা করি কেমোথেরাপি বা রেডিও থেরাপি কীভাবে দিতে হয়। এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কেমন। এগুলো বিস্তারিতভাবে তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা এ সময় খুবই প্রয়োজন হয়।
প্রশ্ন : কেমোথেরাপি এবং রেডিও থেরাপির যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এগুলো জানানোর পর পরামর্শগুলো রোগীরা কীভাবে নেয়? এবং এই পরামর্শ তাদের জন্য কতটুকু ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন?
উত্তর : আমরা দেখেছি রোগীরা প্রথম দিকে বিষয়টি মানতে চায় না। আস্তে আস্তে তারা এ পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়।
প্রশ্ন : চিকিৎসার পর আবার কী সমস্যাটি ফিরে আসে?
উত্তর : দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফুসফুসের ক্যান্সার যদি একেবারেই প্রাথমিক সময় ধরা না যায় তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা পাঁচ বছরের বেশি বাঁচে না। এখন অনেক নতুন কেমোথেরাপি, রিসিপটর বেইজ কেমোথেরাপি চলে এসেছে। সেগুলো দিয়ে আমরা হয়তো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চেষ্টা করি এতে রোগীকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আর প্রথম সময়ে যদি ধরা পড়ে তাহলে পাঁচ বছরের বেশি সময় পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা যায়। আসলে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ার উপরে রোগীর সুস্থতা অনেকটা নির্ভর করে।
প্রশ্ন : প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার যাতে ধরা পড়ে সে জন্য কী করা জরুরি?
উত্তর : যারা চেইন স্মোকার তাদের প্রত্যেক বছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা দরকার। ধূমপান বন্ধ করতে হবে। তারপর বুকের এক্সরে করে দেখতে হবে কী অবস্থা। তার পরে প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান বা অন্য বিষয়গুলো করতে হবে।
প্রশ্ন : ধূমপায়ীর পরিবারের কী কারো ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে?
উত্তর : দেখা গেছে, যে ধূমপান করছে তার পরিবারের ২৫ ভাগ মানুষের মধ্যে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ধূমপায়ীর অফিসের অন্যদের মধ্যে (২৫ ভাগ) ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের অনেক রোগী বাইরে চলে যাচ্ছে। কেন তারা এমন করে, কী মনে হয়?
উত্তর : সারা বাংলাদেশে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ ক্যান্সারের রোগী আছে। অথচ আমাদের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সংখ্যা দেড় শরও কম।
বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান অ্যান্ড সার্জন, এ ব্যাপারে কাজ করে থাকে। তারা ফেলোশিপ দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের আরো ভালো কাজের জন্য কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়া যেত এবং কলেজের বিভাগগুলোকে যদি কলেজ করে দেওয়া হতো তাহলে ভালো হতো। আর যারা নতুন নতুন পাস করে বের হচ্ছে তাদের যদি বিদেশে ছয় মাস বা এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে বিশ্বমানের পুরোপুরি সেবাই আমরা বাংলাদেশে দিতে পারতাম।
তবে এখন আমারা বাংলাদেশ অবশ্যই অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আমাদের রোগীরা এখন আগের চাইতে অনেক ভালো আছেন।
প্রশ্ন : রোগীরা যেন বাইরে চিকিৎসার জন্য না যায় সে জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে চিকিৎসকের নাম ধরে রোগী রেফার করেন চিকিৎসকরা। তার মানে আমাদের প্রতি আস্থা পাচ্ছেন বিদেশের লোকজনও। আর সফলভাবে বাংলাদেশে চিকিৎসা হচ্ছে এটি আমাদের কাছে আশার ব্যাপার।