যক্ষায় ওষুধ সেবন করতে হবে নিয়মিত
একটা সময় প্রবাদ ছিল- ‘যার হয় যক্ষা তার নাই রক্ষা।’ তবে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে ফলে এই প্রবাদে পরিবর্তন এসেছে। এখন বলা হয়- ‘যার হয় যক্ষা তার আছে রক্ষা।’ তবে যক্ষামা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে, যদি ঠিকমতো ওষুধ সেবন না করা হয়। আজ সোমবার (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৪৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম মোস্তফা হোসেন।
প্রশ্ন : যক্ষা বা টিবি নামটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, যক্ষা কাকে বলে?
উত্তর : ইংরেজিতে বলে টিউবারকলোসিস, বাংলায় বলা হয় যক্ষা। যক্ষা একটি মাইকোব্যাকটেরিয়াল রোগ। মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকলোসিস নামক একটি জীবাণুর সংক্রমণের মাধ্যমে যক্ষা হয়। যক্ষা একসময় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ছিল। যক্ষার ব্যাকটেরিয়া যখন মানুষের দেহের ভেতর প্রবেশ করে তখন ধীরে ধীরে এটি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন মানুষের শরীরের সঙ্গে এর যুদ্ধ চলে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকলে এটি আপনাআপনি চলে যায়। আর শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে সমস্যাটি বেড়ে গিয়ে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যক্ষা হলে রোগী অনেক দিন ধরে শুকনো কাশি হয়, জ্বর হয়।
প্রশ্ন : কয়দিন ধরে এই কাশিটি হয়? এগুলোর লক্ষণ সম্বন্ধে কিছু বলুন।
উত্তর : কাশি যদি তিন সপ্তাহের বেশি থাকে তাহলে চিকিৎসকরা যক্ষা হয়েছে বলে সন্দেহ করেন। যক্ষা হলে বিশেষত রাতে জ্বর আসে এবং ঘামের মাধ্যমে এই জ্বরটা চলে যায়। আস্তে আস্তে তার ওজন কমে যায়। খাওয়ার অরুচি হয়। তবে এগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে। তারপর যদি রোগটি আরো জটিল আকার ধারণ করে তাহলে কাশির সাথে রক্ত বের হয়, ফুসফুসে ধীরে ধীরে পানি জমে, বুকে ব্যথা হয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এর থেকে খারাপ অবস্থায় গেলে এটা শরীরের হাড়কে আক্রান্ত করতে পারে। কিডনি, চোখ, মস্তিষ্কসহ সারা শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে। এর ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত হতে পারে।
যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে রোগটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আর যদি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে এবং এর সঠিক চিকিৎসা করা হয় তাহলে এসব সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : কোন লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ার ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে?
উত্তর : তিন সপ্তাহ কাশি হওয়ার পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। এই রোগ নির্ণয়ে আমরা সাধারণত কফ পরীক্ষা করি। বুকের এক্সরে করা হয় এবং রক্তের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল পাশাপাশি রোগীর লক্ষণ দেখে আমরা রোগটি নির্ণয় করি।
প্রশ্ন : কী চিকিৎসা দেওয়া হয়? এই চিকিৎসা কতদিন পর্যন্ত দিতে হয়,এটি আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
উত্তর : যক্ষা ভালো হওয়ার জন্য সাধারণত ছয় মাসের চিকিৎসা করা হয়। প্রথম দুই মাস চারটি ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করি। তারপর চার মাস দুই ধরনের ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে যক্ষার ওষুধ কিছুদিন খাওয়ার পর ৮০ ভাগ লক্ষণ চলে যায়। তখন রোগী ভাবে সে হয়তো ভালো হয়ে গেছে। এই ভেবে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এটি খুব বিপজ্জনকও বটে। তখন অন্যরকমভাবে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। তখন ৫টা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা আরম্ভ করতে হয়। ওটা দিয়ে চিকিৎসা করার পরও যদি ভালো না হয় তখন এমডিআর টিবি বৃদ্ধি পায়।
যক্ষার চিকিৎসায় প্রথম দুই মাস যে চারটি ওষুধ দেওয়া হয় তা প্রত্যেক দিন খেতে হবে। একদিনও বাদ দেওয়া যাবে না এবং পরিমাণ মতো খেতে হবে। রোগীর যে ওজন আছে সেটি অনুযায়ী ওষুধের পরিমাণ ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনটি বাক্য (টার্ম) ব্যবহার করা হয়। অবিরাম, পরিমাণমতো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোদিন বাদ না দেওয়া।
যক্ষার কিছু কিছু ওষুধ খেলে অনেকেরই চোখ হলুদ হয়ে যায়। বমি বমি ভাব হয়। তখন অনেক রোগী ওষুধ ছেড়ে দেয়। ভাবে হয়তো জন্ডিস হয়েছে বা ওষুধটি হয়তো শরীরের সাথে যায়নি। এ সময় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যক্ষার যদি সঠিক চিকিৎসা করা হয় তবে এটি এখনকার সময় কোনো সমস্যাই নয়। কিন্তু ঠিক মতো চিকিৎসা না করার ফলে জটিলতা বাড়ছে।
যক্ষার কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এ ছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষা হওয়ার প্রবণতা বেশি। পোশাককর্মীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি হতে দেখা যায়। কেননা বেশির ভাগ পোশাক কারখানাতে বাতাস চলাচলের অভাব থাকে, ফলে যক্ষা হয়। অপুষ্টির কারণেও যক্ষা হতে পারে।
এ ছাড়া ডায়াবেটিস থাকলে অনেক সময় যক্ষা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ডায়াবেটিস ও টিউবারকলোসিসকে দুই ভাই বলা হয়।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আপনাদের কী পরামর্শ হবে যাতে যক্ষা না হয়?
উত্তর : ডায়াবেটিস খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ছাড়া এইচআইভির সঙ্গে এই রোগের সম্পর্ক আছে। এইচআইভি হলে টিউবারকোলোসিস হতে পারে। তবে এই সমস্যা বাইরের দেশেগুলোতে বেশি হয়। আর শিশুদের যেন এই সমস্যা না হয় এজন্য বিসিজি ভ্যাকসিন দিতে হয়। জন্মের পর থেকে আরম্ভ করে প্রথম বছরে এই ভ্যাকসিন দিলে শিশুর যক্ষা প্রতিরোধ করা সম্ভব।