পতাকা চুরি
১৯৯৪ সাল। তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। জীবন সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানতাম না বা ওই বয়সে জানার কথাও না। ওই সময়টাতে শুধু বুঝতাম স্কুল, লেখাপড়া আর খেলাধুলা। সে যে খেলাই হোক।
ওই বছরই ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়। বিকেল বেলা খেলার মাঠে কিংবা একসাথে কয়েকজন জড়ো হলেই শুনতাম বড় ভাইয়েরা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলছেন। এমন কি মসজিদে গিয়েও ফুটবল খেলা নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের সময়ে প্রযুক্তি এতো উন্নত ছিল না, যেমনটা বর্তমানে আছে। আমাদের সময়ে বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো টেলিভিশন ছিল না। তাই অনেক কিছুই আমরা জানতাম না। বড় ভাইয়েরা যা বলতেন তা-ই বিশ্বাস করতাম। তাদের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইতালি-জার্মানির কথা, যে এ রকম অনেক দেশ আছে যারা ফুটবল খেলে। আর পৃথিবীর সবগুলো দেশ থেকে বাছাই করে কয়েকটি দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়। তাদের মুখেই প্রথম শুনেছি আর্জেন্টিনার একটা ‘বেশেবা’ (খুব ভালো) প্লেয়ার আছে, যার নাম ম্যারাডেনা। এই ম্যারাডেনা নাকি পাঁচ-সাতজনকে কাটিয়ে একাই গোল দিয়ে দেয়। এমন কী হাত দিয়েও নাকি গোল করেছেন। তবে পরে জানলাম এই গোল নাকি ‘ঈশ্বরের’ হাত দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বলা হয়। আরো নানান কথা। তখন অন্য খেলোয়াড় সম্পর্কেও বলা হতো।
তবে আমার মাথায় শুধু একটাই কাজ করত। ওই ‘বেশেবা’ (খুব ভালো) প্লেয়ার, মানে ম্যারাডোনা। যাই হোক এসব আলোচনা চলাবস্থায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাও শুরু হয়ে গেছে। আমার মনে আছে আগে প্রতি শুক্রবারে বিটিভিতে বাংলা ছবি দিত। তাই আমরা সবাই মিলে টিভির অ্যান্টেনা ঠিক করতাম যাতে বাংলা ছবি চলাকালে কোনো সমস্যা না করে।
আমার মেজ চাচার একটা ২১ ইঞ্চি কালার টিভি ছিল। আমরা সবাই মিলে ওই টিভিটাই দেখতাম। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে নতুন একটা অ্যান্টেনাও কেনা হলো, যাতে খেলা চলাকালে টিভিতে ঝিরঝির না করে। বুঝলাম, বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রস্তুতি ভালোই নেওয়া হচ্ছে। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাটা স্পেশাল কিছু।
আমার সব কিছু ঠিক অক্ষরে অক্ষরে মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে আর্জেন্টিনার যেদিন খেলা ছিল বাসার সবাই জেগে ছিলেন। খেলা শুরু হয়েছিল রাত ১২টার পর। তখনকার জন্য রাত ১২টাই অনেক রাত ছিল। আরামের ঘুম উপেক্ষা করে মাথায় শুধু একটাই কাজ করছিল ওই ‘বেশেবা প্লেয়ারে খেলা দেখব।
যাক খেলা শুরু হলো। টিভির পর্দায় বারবার একটা খেলোয়াড়কে দেখাচ্ছিল। আমার চাচা মরহুম মহসিন রাজা বলছিলেনম, এইটাই হলো ম্যারাডোনা। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই ‘বেশেবা’ প্লেয়ার দেখতে তো অনেক খাটো আর অন্য প্লেয়াররা ম্যারাডোনার থেকে অনেক লম্বা। বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না। কিভাবে কী হবে। তবে ক্যামেরার কাজ ক্যামেরায় ঠিকই করে যাচ্ছিল। বারবার টিভি স্ক্রিনে ওই ‘বেশেবা প্লেয়ারকে দেখাচ্ছিল। খেলা শুরু হলো। বড় ভাইদের কাছে যা শুনেছিলাম তার চেয়েও বেশি এই ‘বেশেবা প্লেয়ার। সত্যি সত্যি চার-পাঁচজনকে কাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বেশেবা প্লেয়ার বল নিয়ে এগিয়ে গেলেই চার-পাঁচজন মিলে তাকে মাটিতে ফেলে দিত। সেই থেকেই ‘বেশেবা প্লেয়ার ম্যারাডোনা ভক্ত হয়ে গেলাম। আর ভক্ত নাট হয়ে পারা গেল না। কারণ আমার সেই বেশেবা প্লেয়ারের জাদুকরী খেলায় ৪-০ গোলে গ্রিসকে হারাল আর্জেন্টিনা। আমার বেশেবা প্লেয়ার ম্যারাডোন করলেন, এক গোল। তবে সেই খেলায় আরো একজন আর্জেন্টিনার বাতিস্তুতা হ্যাটট্রিক করেছিলেন ম্যারাডোনার সহায়তায়। সেই থেকে আমি আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করি।
পরের খেলা দেখব বলে অনেক আগ্রহ করে টিভির সামনে বসলাম। খেলা শুরু হলো ঠিকই তবে আমার বেশেবা প্লেয়ার খেলায় নেই। আমার তো ভীষণ মন খারাপ। কেন নেই। পরে শুনলাম ম্যারাডোনা নাকি খেলার আগে ড্রাগ নিতেন। আর এটি ধরা পড়ায় তাঁকে খেলা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বলতে বলতে দেখি ম্যারাডোনাকে টিভি স্ত্রিনে দেখাচ্ছে। তিনিও অন্যদের মত্যে গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছেন। তবে ম্যারাডোনকে ছাড়া আর্জেন্টিনা সেদিন হেরেছিল। আর্জেন্টিনা যতগুলো গোল খেয়েছিল ম্যারাডোনাকে স্ক্রিনে দেখাচ্ছিল আর ম্যারাডোনা কাঁদছিল। তাঁর কান্না দেখে আমিও কাঁদছিলাম। ওই সময়ে এতটুকুই মনে আছে।
১৯৯৮ সাল আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আবারও সেই বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়। তবে এখন আমি ফুটবল সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। নিজেও ফুটবল একটু আধটু খেলি। তবে ম্যারাডোনার মতো না। আমি গোলকিপার খেলি। সত্যি কথা বলতে কী যখন থেকে খেলায় গেছি বড় ভাইয়েরা বল ধরার জন্য গোলকিপার বানিয়ে দিতেন। তারপর থেকে জীবনে আর সামনে খেলা হয়নি। এইচএমপি স্কুলের হয়ে কয়েকবার বি টিমের গোল কিপার খেলেছি।
আসি আসল কথায়। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে প্রায় প্রতিটি দোকানে-দোকানে আর বাড়ির সামনে যে যেই দল সার্পোট করে সেই দলের পতাকা টাঙ্গিয়েছে। মাটি ছাড়া যদি উপরের দিকে তাকাতাম মনে হতো অন্য কোন দেশে আছি। যাক এসব কথা। কথা হলো সবাই যে যার দল সার্পোট করে তারাই তাদের ভালো লাগা দলের পতাকা লাগাচ্ছে। শুধু আমি না। অথচ সেই সময়ে আমি ঘোর আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। কেউ যদি আর্জেন্টিনা নিয়ে কিছু বললেই ঝগড়ায় লেগে যেতাম। কী যে করি একটা পতাকা তো চাই-ই চাই, সে যেভাবেই হোক।
আমার বড় ফুপুর বাসা হাসননগরে। ফুপুর বাসায় যাওয়ার সময় দেখতাম মাথার উপরে বড় একটা আর্জেন্টিনার পতাকা লাগানো। দেখে ভালো লাগত।
আমার এক চাচাতো বড়ভাই সেও আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করে। তবে সে আমার থেকেও বেশি। সেই চাচাতো ভাইয়ের আবার কারও গাছ থেকে না বলে পেয়ারা কিংবা নারকেল পাড়ার অভ্যাস আছে। তো একদিন কথায় কথায় বললাম যে ভাই আমরাও তো আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করি কিন্তু আমাদের তো কোন পতাকা নেই। সে বলল, দূর এই পতাকা দিয়ে কি হবে! আমরা তো আমাদের মন থেকেই সাপোর্ট করি। আমি বললাম, না ভাই একটা পতাকা না হলে তো হবে না। আমাদের পাশের বাড়ির ওরা গাছের মগডালে ব্রাজিলের পতাকা লাগিয়েছে। তখন আমার চাচাতো ভাইটি বলল. আচ্ছা হাজীপাড়ায় দেখছি একটা পতাকা আছে কাউকে না বলে নিয়ে আসব। আমি বলি না না চুরি করে আনব? সে বলল চুরি কি। কেউ দেখলে চুরি না দেখলে তো চুরি না। খুব স্বাভিকভাবেই বলল। তখন আমিও ভাবলাম সত্যিই তো না দেখলে তো চুরি না। মাথায় শুধু এইটাই কাজ করছে কেউ না দেখলে চুরি না। আসলে নিজের মনকে একটা মিত্যা যুক্তি দিয়ে বুঝাচ্ছি আর কি। আর বুঝানো ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ একটা বড় পতাকার দাম অনেক টাকা যদিও ছোট পতাকা একটা কেনা যেত কিন্তু তা দিয়ে তো আর মন ভরবে না! তাই অনেক বড় পতাকা চাই।
একদিন রাতে খব বৃষ্টি হচ্ছে। আমি আর আমার চাচাত ভাই আমার ফুফুর বাড়ি থেকে আসছি। সেই দিন আবার আর্জেন্টিনার খেলা। আসার পথে খেলা নিয়েই কথা বলছি। হঠাৎ আমার চাচাত ভাই আমাকে বলল তুই যে বলেছিলি কোথায় যেন একটা পতাকা আছে? আমি বললাম ভাই ওই তো সামনের দোকানে। সে বলল চল আজই পতাকা নিব। তার এই কথা শুনেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। হাত-পা কাঁপছিল। কারণ আমি জানতাম সে যেহেতু বলেছে আজকে নিবে তার মানে আজকেই নিবে। বলতে বলতে পতাকার কাছে পোঁছালাম। বৃষ্টি এতোই বেশী ছিল যে রাস্তায় কোন রিকসাও ছিলনা। আমার আর আমার ভাইয়ের পড়নে রেইন কোট ছিল সে আমাকে বলল শুন ভালো করে রেইন কোটে হেট দিয়ে মুখ আর কপাল পর্যন্ত বেঁধে ফেল। আমি তাই করছিলাম সে যা বলছিল। এদিকে ভয়ে আমার হাত নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। তবে সত্যি কথা বলতে কি আমি এই প্রথম বার চুরি করছি। সে যাই হোক ছোট চুরি আর বড় চুরি, চুরি তো চুরি-ই ধরা পড়লেই তো শেষ। সেদিন এক দোকানে চুরি করার দায়ে চোর বেটাকে ধরে উত্তম-মাধ্যম তো যা দেয়ার দেয়া হয়েছে। তার মাথার চুল ইঁদুরে খাওয়ার মতো করে কেটে দেয়া হয়েছে। কেন জানি বারবার আমার ঐ কথাই মনে পড়ছে। আবার এইটাও মনে হচ্ছে কেউ না দেখলে তো চুরি না। আমি এই কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি আমার চাচাত ভাই লাফ দিয়ে ঐ দোকানের জানালায় পা দিয়ে উপরে উঠে গেল। আর আমাকে বলল তুই দেখিস কেউ আসে কি না। পতাকার কাছে গিয়ে বলে বাঁশে খুব শক্ত করে বাঁধা ছিল তাই সে আমাকে বলল পতাকা বাঁশ থেকে খোলা যাচ্ছেনা। তাই আমাকে বলল ধারালো কিছু খোঁজে দেয়ার জন্য। আমি একটা সেলুনের ফেলে দেয়া ব্লেড নিয়ে ভাইয়ের হাতে দেই । সে বাঁশ থেকে পতাকা খুলেই লাফ দিয়ে নিচে নেমেই বলে। দৌড় দে আমিও কিছু না বুঝেই দৌড় দিলাম। প্রায় দৌড়ে দৌড়ে বাসায় আসলাম। আমার চাচাত ভাই আমাকে বলেছিল দেখেছিস বলেছিলাম না দেখলে চুরি না দেখলে কিছুই না। বাসার সামনে এসে পতাকা খুলে দেখি একটা বিছানার চাদরের সমান। সেই সময়ের জন্য এই পতাকা অনেক বড়। যাক পতাকা তো আনা হলো এখন ঘরে এই পতাকা কিভাবে দেখাব বা জিগ্যেস করলে কি বলব। মহা মুশকিলে পড়লাম। চুরি করে আনা থেকে এখন আরোও মসিবতে আছি। তো আমার সেই চাচাত ভাই টেলেন্ট সে বলল শোন এতো চিন্তা করে লাভ নাই ঘরে জিগ্যেস করলে বলব যে আমাদের ফুফুত ভাই দুইটা পতাকা বানিয়েছে। একটা তারা লাগিয়েছে আর একটা আমাদের দিয়ে দিয়েছে। পরের দিন আমাদের পাশের বাসার ব্রাজিলের পতাকা থেকেও উপরের কদম গাছে আমাদেও পতাকা লাগিয়েছিলাম। আমাদের পতাকা তাদের পতাকা থেকে ৫গুন বড় দেখাচ্ছিল। আর তাদেরটা আমাদের চেয়ে অনেক ছোট। পাড়ার সবাই পতাকা দেখতে এসেছিল। যারাই আমাকে পতাকা নিয়ে কিছু জিগ্যেস করছে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছিল। এই বুঝি কেউ একজন এসে বলবে এইটা আমাদের পতাকা যা গতরাতে চুরি হযেছে। কেনজানি এই কথাই মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত লজ্জা না পেতে হয়। পতাকা না লাগিয়ে যেমন অনুভূতি ছিল লাগানোর পর আরো খারাপ লাগছিল। আর যা-ই হোক চুরির পতাকা। নিজে না হয় একটা পতাকা কিনতে না-ই পারলাম তাতে কী। আর আমরা কোন দিন ওই পতাকাটি টাঙ্গাইনি। এই পতাকার সঠিক জায়গাটি ও আমার চাচাত ভাইয়ের নামটি ব্যবহার করলাম না। আসলে ফুটবল খেলায় নিজের দেশ নাই তার পরও আমার আমরা যে ফুটবল খেলা ভালবাসি সেটি দেশের শতকোটি মানুষের। আমরা অন্য দেশের ফুটবল খেলাকে ভালোবেসে তাদের দেশের পতাকা লাগাই যেহেতু আমাদের দেশ নেই। আর থাকলে হয়তো আমাদের অন্য দেশের পতাকা লাগাতাম না। তবে একটা কথা বলি বর্তমানে আমরা দেখি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে আমরা বিভিন্ন দেশের পতাকা ভালোবেসে সেই দেশের ছবি আপলোড করি। আবার এমনও কিছু মস্তিস্ক বিকৃত মানুষ আছে যারা অন্য দেশের পতাকাকে অপমান করেন। যেটি কখনই কাম্য নয়। আমরা যদি অন্য দেশের পতাকাকে সম্মান না করতে না পারি অন্তত অপমান করবনা।
আমার সেই বেশেবা প্লেয়ার ম্যারাডোনার ভালোবাসার হিসেবে পতাকা পতাকা চুরি করেছিলাম। আর বর্তমান সময়ের ম্যাজিক মেসীর খেলার যাদুতে মনে হয় আমার সেই পতাকা চুরি সার্থক ছিল। যদিও চুরি চুরি-ই। এবারের বিশ্বকাপে একটা ইয়া বড় পতাকা বানিয়েছি তবে চুরি করে নয়, নিজের টাকা দিয়ে। ২০১৮ রাশিয়ার বিশ্বকাপ মেসিদের দেশে যাবে এই প্রত্যাশা করি।