কাপ যুদ্ধ
অঙ্ক আর স্বপ্নের ভেলায় আর্জেন্টিনা
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে মেসির পেনাল্টি মিস! স্তব্ধ আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। বাকি পৃথিবীর কাছেও বিষয়টা প্রায় অবিশ্বাস্য! কিন্তু ইতিহাসের ধূসর পাতা উল্টাতে উল্টাতে খানিকটা বিশ্বাস ফিরে পেলেন তাঁরা। পেনাল্টি মিস! সেটা তো বিশ্বকাপে জিকো-প্লাতিনি-ব্যাজিওরাও করেছেন। বরফের মতো জমাট বাঁধা শোক বুকে নিয়েও তাই ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন তাঁরা। তাঁদের হৃদয়ের গহিনে জমাট বাঁধা কষ্টের বরফ গলতে থাকে ভিন্ন গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত এক আশার আলোয়। তাঁর নাম লিওনেল মেসি। এই নামটাই পৃথিবীর বহু মানুষের কাছে ফুটবলানন্দের প্রতিশব্দ। কিন্তু সেই মেসি ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে যখন ম্যাচ শেষে মাঠ ছাড়লেন, তিনি রীতিমতো বিপন্ন। বিধ্বস্ত। উদ্ভ্রান্ত। কারণ, কাপ যুদ্ধে আর্জেন্টিনা তাঁর স্বপ্ন সাম্রাজ্য প্রায় হারাতে বসেছে।
বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনার দৃষ্টির অনেক বাইরে। তাদের দৃষ্টির সীমানায় বিশ্বকাপ বলে কিছু ধরা পড়ছে না। বরং সময়ের দূরবীন দিয়ে ইতিহাসের পাতায় ’৭৮ আর ’৮৬-কে দেখতে পান তাঁরা। রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনা যা খেলেছে, তাতে এই দল বিশ্বকাপ জিতলে সেটাই হতে পারে অবিশ্বাস্য! হ্যাঁ, মেসির পেনাল্টি মিসের চেয়েও অবিশ্বাস্য।
আর্জেন্টিনা কেন জিতবে বিশ্বকাপ? অনেকের মুখ থেকে আবেগাশ্রিত উত্তর বেরিয়েছে। এবার বিশ্বকাপটা তারা জিতুক শুধু মেসির জন্য! মেসির হাতে ফুটবলে গ্রহের সব উঠেছে, শুধু বিশ্বকাপটা ওঠেনি। এবার ওর হাতেই কাপটা উঠুক। মেসির মতো গ্রেট বিশ্বকাপ ছাড়া ফুটবল থেকে বিদায় নেবে, এটা হতে পারে না! এই আষাঢ়ে আবেগের বৃষ্টি ধারা ঝড়েছে বহু মানুষের কণ্ঠে! আবার এটাও ঠিক, একজন মেসির জন্য যদি আর্জেন্টাইন ফুটবলাররা বিশ্বকাপ জিততে চান, তাতে দোষের কিছু নেই। সমালোচনারও কিছু নেই। কারণ, কে কীভাবে বিশ্বকাপ জিতবে বা জেতার জন্য উদ্দীপ্ত হবে, সেটা একেবারে তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কেউ চাইতে পারেন, দেশের জন্য জিতবেন। কেউ চাইতে পারেন, নিজের জন্য জিতবেন। কেউ চাইতে পারেন, মেসির জন্য জিতবেন। আসল কথা হচ্ছে, মোটিভেটেড হওয়া। কিন্তু এই আর্জেন্টিনা দলটাকে কি আদৌ কাপ জয়ের জন্য মোটিভেটেড মনে হলো গত দুটি ম্যাচ দেখে! গোটা দলের শরীরের ভাষা, চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে কি তেমন কিছু ফুটে বেরিয়েছে, যে বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা এদের আছে? কিংবা এরা কাপটা জিততে চায়? এই দলে এমন কাউকে কি দেখলেন, যিনি গোটা দলকে উদ্দীপ্ত করছেন? অনুপ্রাণিত করছেন? আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সি পরে যে ভদ্রলোক মাঠে ছিলেন, তিনি কি সত্যিই লিওনেল মেসি? নাকি পুতিনের দেশে মেসির মুখোশ পরা কাউকে দেখল ফুটবল বিশ্ব! এই মেসি কোন গ্রহের ফুটবলার, জানি না। তবে পৃথিবী নামক এই গ্রহে যে ফুটবল যুদ্ধ চলছে, সেখানে তাঁকে কেন যেন বেমানান মনে হচ্ছে। ফুটবল বিশ্ব যে লিওকে চেনে বা দেখেছে তাঁর সাথে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভদ্রলোক নিজেই যেন বিধ্বস্ত। বিপন্ন। অথচ গত দেড় দশকে আর্জেন্টাইনদের ফুটবল ত্রাতার নাম লিওনেল মেসি। দলটাকে রাশিয়ায় টেনে নিয়ে এসেছিলেন প্রায় একা কাঁধে করে। কিন্তু মেসি একেবারে ম্রিয়মাণ। নিজের নামের ভার বহন করার ক্ষমতাও যেন তার নাই! নামের ভার আরো কয়েক গুণ যেন বাড়িয়ে দিয়েছেন রাশিয়ায় ভিআইপি বক্সে আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের উপস্থিতি। ক্রোয়েটদের কাছে মেসি এবং তাঁর আর্জেন্টিনার অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছেন খোদ আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা!
ম্যারাডোনা বহু যুদ্ধে জিতিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে। নিজের জীবনেও অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন। কিন্তু সেই তিনিই দেখলেন এবং বুঝলেন তাঁর উত্তরাধিকার এই আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের কাছে রীতিমতো বোঝা। গত তিন দশক ধরে সেটা বয়ে বেড়াতে বেড়াতে তারা ক্লান্ত। আর তাঁর রেখে যাওয়া সাফল্যের পুঁজির সঠিক বিনিয়োগ করতে পারেনি আর্জেন্টাইনরা। সেটা সুদে-আসলে বাড়া দূরে থাক, মূলধন নিয়েই টান পড়ছে! আসলে ম্যারাডোনা আর্জেন্টানদের ফুটবলীয় সমৃদ্ধির যে রাস্তা দেখিয়েছিলেন, সেই রাস্তা তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা আর খুঁজে পাচ্ছেন না। বরং কাপ জয়ের জন্য একটা মন্ত্র জপতে জপতে গত দেড় দশক পার করে দিলেন তাঁরা! মেসি!
মেসি আর্জেন্টাইনাদের একমাত্র জয়মন্ত্র। অনেক যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁরা এই মন্ত্রে। কিন্তু বিশ্বকাপের মহাযুদ্ধে জয় পেতে গেলে আরো কিছু মন্ত্র জানা লাগে। এই আর্জেন্টিনা দলের সেটা জানা নেই। মেসি বিশ্বকাপ বাদ দিলে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারে সুপার অ্যাচিভার। কিন্তু বিশ্বকাপ! সেটা অনেক বড় প্রাইজ। অনেক বড় যুদ্ধ শেষে সেই প্রাইজ হাতে উঠে। মেসি নিজেও সেটা জানেন। জীবন তাঁকেও অনেক কিছু শিখিয়েছে। গোটা আর্জেন্টিনাসহ পৃথিবীর বহু মানুষ তাকিয়ে মেসির দিকে। মানুষ যেমন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে কিছু পাওয়ার জন্য। তেমনি আর্জেন্টাইনদের আর একটা বিশ্বকাপের জন্য প্রার্থনা শুধুই মেসির কাছে! কিন্তু সেই মেসি কার ওপর ভরসা রাখবেন? তার এই দলে এমন কেউ নেই, যার ওপর ভরসা রাখতে পারছেন মেসি। রাশিয়ায় আর্জেন্টাইনদের শাপমুক্তি ঘটাতে হলে মেসিকেই খুঁজে নিতে হবে পথটা। আর তাকিয়ে থাকতে হবে নাইজেরিয়ানদের দিকে। আফ্রিকান সুপার ঈগলরা যদি রুখে দিতে পারে আইসল্যান্ডকে আর পরের ম্যাচে সেই সুপার ঈগলদের বিরুদ্ধে যদি গোল উৎসবে মেতে উঠতে পারে আর্জেন্টাইনরা, তাহলে বিশ্বকাপের পরের রাউন্ডে যাওয়ার হিসাবটা মিলে যেতে পারে আর্জেন্টিনার।
তবে হ্যাঁ, মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। স্বপ্নকে তাড়া করে। আর্জেন্টিনাও হয়তো এখনো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু বিশ্বকাপ নামক স্বপ্নযাত্রায় এখন আর্জেন্টিনাকে প্রবল স্রোতের বিপরীতেই সাঁতার কাটতে হবে। স্বপ্নের ভেলায় রাশিয়ায় এখনো ভেসে আছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু ডুবতে কতক্ষণ!
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।