ক্রিকেট
জয়মন্ত্রের নাম ‘ম্যাশ’
ট্যালেন্ট, স্কিল এবং মন। এই তিনটাই তাঁর আছে। ট্যালেন্ট-স্কিল-মন। এই তিন স্টাম্পের ওপর যদি রাখা হয় মাশরাফি বিন মুর্তজার সাফল্যের দুখানা বেল, তাহলে তাঁর অফ স্টাম্প হবে কোনটি? বাইশগজে সফল হতে হলে সব ব্যাটস্যানকেই আগে জানতে হয় তাঁর অফ স্টাম্প কোথায়। ক্রিকেটার মাশরাফির অফ স্টাম্প কোথায়, তা সবচেয়ে ভালো জানেন যিনি তাঁর নামও মাশরাফি বিন মুর্তজা। তারপরও মাশরাফির সাফল্য রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বড় বড় বিশেষজ্ঞ, ক্রিকেট লিখিয়েরা অনেক কিছু খুঁজে পান। সেটা তাঁরা বলছেন। লিখছেন। কিন্তু পুরোপুরি সঠিক ব্যাখ্যাটা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে ক্রিকেট-উত্তর জীবনে মাশরাফির নিজের লেখা আত্মজীবনীতে। সেটা হয়তো হবে ‘ম্যাশ : দ্য আনটোল্ড স্টোরি’। তারপরও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ রুটি-রুজির তাগিদে কিছু কথা আর শব্দ নিয়ে মাশরাফিদের সাফল্য ফেরি করে বেড়াই! ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্নবাজ মানুষগুলোর কাছে সেগুলো বিক্রি করাও খুব কঠিন কিছু না। তবে হ্যাঁ, ফেরিওয়ালা যেমন জানেন না, অনেক পণ্যের রসায়নটা কী, আমরাও তেমনি সত্যিই জানি না অধিনায়ক মাশরাফি, বোলার মাশরাফির সাফল্যের আসল রসায়ন কী!
লম্বা একটা সময় ধরে বাংলাদেশের ওয়ানডে সাফল্য মানেই মাশরাফি জাদু! তাঁর জাদুমন্ত্রটা কী? কেন তাঁর ছোঁয়ায় ভেঙে পড়া বাংলাদেশ দলটাও উঠে দাঁড়ায়! ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজে কী হতশ্রী চেহারা বাংলাদেশ দলের! আবার ওয়ানডেতে মাশরাফির হাতের ছোঁয়ায় সেই দলটাই কীভাবে পাল্টে গেল! এটাও রীতিমতো এক বিস্ময়। মাশরাফির ক্রিকেট ক্যারিয়ারের জয়মন্ত্র খুঁজে পেতে হয়তো লম্বা সময় গবেষণা করতে হবে আগামীতে। খুঁজে বের করতে হবে তাঁর সাফল্যের বেল দুখানা রাখা তিন স্টাম্পের অফ স্টাম্প কোনটা। ট্যালেন্ট, স্কিল নাকি মন। ক্যারিয়ারে আবির ছড়ানো অস্তরাগ হয়তো মাশরাফি নিজেও দেখছেন। কিন্তু সেখানেও এত রঙিন, এত উজ্জ্বল থাকা কীভাবে সম্ভব!
সম্ভব। কারণ তাঁর অফ স্টাম্প ট্যালেন্ট কিংবা স্কিল নয়। মন। যে কারণে ক্রিকেটযুদ্ধে বারবার জিতে আসছেন তিনি। শুধু ক্রিকেটযুদ্ধ বলছি কেন! দেড় দশকের বেশি সময়ের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কি কম যুদ্ধ করতে হয়েছে তাঁকে? কিন্তু বারবার তিনি জয়ী। কী তাঁর জয়মন্ত্র? তার উত্তরেও বলতে হচ্ছে ‘মন’। কৈশোর পেরোনো কৌশিক ক্যারিয়ারের উত্থান পর্বে জানান দিয়েছিলেন ট্যালেন্ট কী জিনিস। বল হাতে বাইশগজে গতিঝড় তোলা বাংলাদেশের প্রথম পেসার তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখে সেটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই গতি কেড়ে নিল সাত-সাতবার অপারেশন থিয়েটারের তাঁর পায়ে ডাক্তারের কাঁচি-ছুরির ছোঁয়া! গতি হারালেন। কিন্তু নিজের স্কিলকে উন্নত করলেন। তবে এখন যদি ধরা হয় তাঁর সাফল্যের নির্ণায়ক হচ্ছে স্কিল, তাহলে ভুল হবে। হয়তো মস্তবড় ভুল হবে। জন্ম তাঁর প্রতিভা নিয়ে। প্রতিভার জোরে অন্যদের চেয়ে আলাদা তিনি হয়ে যেতেই পারতেন। কিন্তু বারবার অস্ত্রোপচার করে আবার বোলিং মার্কে ফেরার প্রাণপণ লড়াই করার রসদ জুগিয়েছে তাঁকে তাঁর মন।
কৌশিক থেকে মাশরাফি হওয়া, আবার মাশরাফি থেকে ‘ম্যাশ’ বনে যাওয়া এবং থেকে যাওয়ার কঠিন কাজটা করছে তাঁর মন। ওটাই তার অফ স্টাম্প। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ১০ ওভার বল করা। ৩৭ রানে ৪ উইকেট নেওয়া, সত্যিই বিস্ময়কর! মধ্যে ত্রিশে দাঁড়িয়ে থাকা, সাতবার পায়ে অস্ত্রোপচার করা এক পেসারের এই সাফল্যে আপনি আমি যতটা বিস্ময় আক্রান্ত হয়ে পড়ি, তিনি তা হন না। এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। কারণ, তাঁর মন। মাশরাফির কাছে ট্যালেন্ট, স্কিল নয়, আসল হচ্ছে মনোভাব। সাফল্য-ব্যর্থতার ঢেউে ভাসতে ভাসতেই ক্যারিয়ারের দেড় দশক পার করেছেন তিনি।
সাফল্যের স্কেলে মাপা হলে মাশরাফির চেয়ে বড় ক্রিকেটার তাঁর দলেই আছেন। কিন্তু মাশরাফির মতো তাঁদের মনোভাব কি সাধারণ মানুষকে সেভাবে অভিভূত করে? সত্যি কথা, করে না। বিশ্বাস না হলে জনজরিপ করে দেখতে পারেন। যেকোনো লড়াইয়ে নিজেকে সতেজ-টগবগে রাখার কাজটা শুধু হাড়ভাঙা পরিশ্রম দিয়ে হয় না। চূড়ান্ত পর্বে আসল জিনিসটা হচ্ছে মন। মনই মানুষের মোটিভেশনের জায়গা। এই জায়গায় ম্যাশ তাঁর দলের অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যান। আবার নিজের এই মনোভাব দিয়ে গোটা দলকে জাগিয়ে তোলেন।
ম্যারাডোনার মতো অসম্ভব প্রতিভাবান, স্কিল ফুল আর টগবগে ফুটবলারকেও নিজেকে আর দলের খেলোয়াড়দের ’৮৬-এর বিশ্বকাপে মোটিভেটেড করতে মেক্সিকোর হোটেল রুমের দেয়ালে আর দরোজায় চে গেভারার ছবি টাঙিয়ে রাখতে হয়েছিল। পড়ে শোনাতেন চে গেভারার ‘বলিভিয়ান ডায়েরি’। যেখানে লেখা আছে, ‘জয় না আসা পর্যন্ত লড়াই চলবে।’ সেই কথার সুর ধরে ম্যারাডোনাই লিখেছেন, ‘জয়ের পরও একটা জয় থাকে। সেটা নতুনভাবে বাঁচার প্রেরণা দেয়।’ মাশরাফি এবং তাঁর দলের মোটিভেশন মাশরাফির মনোভাব। ক্রিকেটের বাইশগজ মানে তাঁর কাছে যুদ্ধ। যে যুদ্ধে নেমে তিনি বারবার হয়ে যান বিপ্লবী। যে বিপ্লব তাঁর ক্রিকেট জীবনের উচ্চতম বিকাশের পরিচায়ক। মানুষ হিসেবে নিজের শিক্ষাকে পূর্ণ করার সেরা সুযোগ। মাশরাফি আসলে মাঠে নেমে শুধু ক্রিকেট খেলেন না। যে পতাকার তলে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন, সেটা উঁচুতে তুলে ধরা মানে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা। কখন সফল হয়েছেন, কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পালানো তাঁর জীবন দর্শনে নেই। তাই আট থেকে আঠারো, আটাশ থেকে আটচল্লিশ, আটষট্টি থেকে আশি, বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের মুখে তাঁর নাম। এটাই তো ম্যাশের লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। ম্যাশের সাফল্যের রসায়ন ক্রিকেট ল্যাবরেটরিতে খুঁজে লাভ কি!
ম্যাশ নিজেই এক জয়মন্ত্রের নাম। আগামী বছরের বিশ্বকাপ পর্যন্ত আমরা সেই জয়মন্ত্র জপতে থাকি। এক-আধটা পরাজয়ের ধাক্কায় যেন সেটা ভুলে না যাই। ওয়ানডে ক্রিকেটে ম্যাশই এখন বাঙালির নামসংগীত। পরের প্রজন্মকেও মাশরাফির মনোভাব নিয়ে উঠে আসতে হবে, তাহলে তাদের হাতেও ধরা দেবে জয়।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।