ক্রিকেট
এখনো ভরসা মাশরাফি-তামিম-সাকিবরাই
জয়ের চাকা গায়ানায় দ্বিতীয় ম্যাচে আটকে না গেলে সিরিজ ফয়সালা ওখানেই হয়ে যেত। কিন্তু হলো সেন্ট কিটসে। যেখানে আগের ম্যাচের অনেক গ্লানি ঢাকা পড়ে গেল। নয় বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ।
হ্যাঁ, জিতল। আর তামিমের হাত ধরে সাকিবের সরণিতে পা রাখলেন মাশরাফি! নিশ্চিত, শেষ বাক্যটা পড়ে বাঙালি ক্রিকেট রসিকরা একটু ধাক্কা খাচ্ছেন। বিস্মিত হচ্ছেন। মাশরাফিভক্তরা হতাশ বা বিরক্ত নন, রীতিমতো ক্ষুব্ধ হতে পারেন। হতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাস আর পরিসংখ্যান তাই বলছে। নয় বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজজয়ী বাংলাদেশ অধিনায়কের নাম সাকিব আল হাসান। যদিও সে নামটা হতে পারত মাশরাফি। কিন্তু ইনজুরি আরো একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল মাশরাফির সঙ্গে। ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগেই দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন তিনি। স্ট্যান্ড ইন ক্যাপ্টেন হয়ে যান সাকিব। তাঁর অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশ প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ জিতেছিল। তারপর এবার মাশরাফির নেতৃত্বে সিরিজ জিতল। এ ম্যাচে তামিম দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করলেন। ১২৪ বলে ১০৩ রান। ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিনি। ম্যান অব দ্য সিরিজও তিনি।
এই ম্যাচ আর সিরিজজুড়ে তামিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। আর স্কোরকার্ডও সে রকম বিমাতাসুলভ আচরণ করার সুযোগ কাউকে দিচ্ছে না। তবে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচটা কি শুধুই তামিমময় হয়ে থাকল! হয়তো পুরোপুরি নয়। আবার তামিমময়ই! দায়িত্বশীল ব্যাটিং আর সেঞ্চুরিতে তাঁর গুণগ্রাহীদের তিনি বার্তা দিয়ে দিলেন—আগামীতে আরো অনেক কিছু লিখতে হবে তাঁকে নিয়ে। কিন্তু এই ম্যাচজুড়ে ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউয়ের মতো পুরোনো সেই বার্তাটা বারবার আছড়ে পড়ল বাংলাদেশ শিবিরে। দলে সিনিয়রদের জায়গা নেওয়ার মতো খেলোয়াড় উঠে আসছেন কোথায়? সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ক্রিকেটে খুব চর্চিত বিষয় এটি। তারপরও কেন আবার সেই প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে? তুলে দিচ্ছে স্কোরকার্ড। তামিমের সেঞ্চুরি। সাকিব-তামিমের ৮১ রানের পার্টনারশিপ। মাহমুদউল্লাহর আগ্রাসন আর দায়িত্বশীলতার মিশেলে খেলা অপরাজিত ৬৮ রানের ইনিংস। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আগের ম্যাচে যে তরুণদের ওপর ভরসা রেখেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, তাঁরা তাঁকে শুধু হতাশ করেননি। হয়তো খানিকটা ক্ষুব্ধও করেছিলেন। যে ক্ষোভের দৃশ্যমান বহিঃপ্রকাশ হয়তো তিনি করেননি। সেটা তাঁর ক্যাপ্টেন্সির সহজাত অভ্যাস। কিন্তু পরোক্ষভাবে এ ম্যাচে বুঝিয়ে দিলেন—করপোরেট পুঁজির মতো নতুনদের ওপর লগ্নি করে আপাতত লোকসানের ভাগিদার হতে নারাজ তিনি। তাই নামের আগে ‘প্রতিভাবান’ লেখা অনেককে ড্রেসিংরুমে রেখে ব্যাট হাতে ছয় নম্বরে নিজেই নেমে পড়লেন মাশরাফি। তাঁর এই সাহসী সিদ্ধান্ত ক্লিক না করলে কী হতে পারে, সেটাও তিনি জানতেন। তাঁর দিকেই হয়তো আক্রমণের বাণ ছোড়া হতো। তাই ক্যারিবীয় বোলারদের সামলানোর একটা পথই বেছে নিলেন তিনি। আক্রমণ, আক্রমণ এবং আক্রমণ। ২৫ বলে করলেন ৩৬ রান। তিনি ফিরলেন। কিন্তু দলকে রেখে গেলেন তিনশ রানের পিলার লেখা হাইওয়েতে। মাহমুদউল্লাহ দলকে সেখানে নিয়েও গেলেন। স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের নামের পাশে ৩০১ রান! তখন সেটা দেখে মনে হচ্ছিল স্টেডিয়ামের এক পাশের পাহাড়ের মতো। আবার অন্য পাশের ক্যারিবীয় সাগরের মতো বিস্তৃত বিশাল স্কোর।
৩০১ রান তাড়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিততে পারে। এই ভরসা ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান কেউ তাদের জোগাতে পারছিল না। কারণ, এর আগে ৩৫ বার ৩০০ বা তার বেশি তাড়া করে ক্যারিবীয়রা জিতেছে মাত্র একবার। হেরেছে ৩৪ বার। আশার বিপরীতে তাদের একমাত্র আশার নাম ছিল ক্রিস গেইল। ঝড় তোলার চেষ্টাও করলেন তিনি। কিন্তু ক্রিস-ঝড় থামতেই মোটামুটি রাত জেগে থাকা বাংলাদেশের অর্ধেক খানিকটা স্বস্তি নিয়েই ঘুমাতে গেল। হ্যাঁ, বাংলাদেশের বোলিং তেমন কিছু নয়। তবে তাদের একেবারে স্কুল পর্যায়ের বোলারে নামিয়ে আনার মতো ব্যাটসম্যানও ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেই। তারপরও ক্যারিবীয়দের সান্ত্বনা ওরা লড়াই করেছে। আর আগের ম্যাচটা জিতে সিরিজ জয়ের আশাটা বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তাদের আশার কফিনে পেরেক ঠুকে দিলেন তামিম-সাকিব-মাহমুদউল্লাহ-মাশরাফি মিলে। বাংলাদেশ দলের এই সিনিয়রদের সামনে আরো একবার খুব বিপন্ন মনে হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আবার এদের সৌজন্যে আপাত প্রসন্ন বাংলাদেশ। আবার এদের পারফরম্যান্স তুলে ধরে আগামী দিনে দুর্দশাগ্রস্ত এক কল্পিত বাংলাদেশের অবয়ব! সেই শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো কোনো পারফরম্যান্স কি দেখা গেল কোনো তরুণের গোটা সিরিজে? এখনো বাংলাদেশের বাজির ঘোড়া সেই সিনিয়ররা। ওরাই এখনো হাত ধরাধরি করে ম্যাচ জেতাচ্ছেন। সেখানে নতুন কোনো হাত দেখা যাচ্ছে না।
ইতিহাসের সরণিতে সাকিবের সঙ্গে হাত রাখলেন মাশরাফি। তার মাঝখানে আবার তামিমের হাত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে সিরিজ জিতে আসা বাংলাদেশের একমাত্র অধিনায়ক ছিলেন সাকিব আল হাসান। নয় বছর পর ইতিহাসের সেই সরণিতে মাশরাফি। নিঃসঙ্গতা কাটল সাকিবের। ইতিহাসের সরণিতে নিঃসঙ্গতা কাটানো এই জয়ে তাঁরও খানিকটা ভূমিকা থাকল। প্রসন্ন হতে পারেন তিনিও।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।