সুনীলের ‘নীললোহিত’
‘নীললোহিত’ নামটির ভেতরই আছে এক রহস্যময়তা। লাল রং কী করে আবার নীল বর্ণ হয়? রহস্যের এখানেই শেষ নয়। বয়স তার সাতাশ। বছর বছর পার হয় কিন্তু বয়স তার আটকে থাকে সেই সাতাশেই। এদিকে এ যুবকটি বলতে গেলে চির বেকার। মাঝেমধ্যে অবশ্য চাকরিতে ঢুকেছে। কিন্তু বেশি দিন তা টেকেনি। বাড়িতে আছে তাঁর বিধবা মা, দাদা ও বৌদি। একটাই বুকপকেটঅলা হাওয়াই শার্ট তার। আত্মপক্ষ সমর্থনে এর যুক্তি হলো : ‘মানিব্যাগ রাখার অভ্যেস আমার নেই কখনো। যখন যা দু’চার টাকা থাকে, বুকপকেটেই রাখি। আর প্যান্টের পকেটে রাখলে চেপ্টে যায় বলে সিগারেট-দেশলাইও ঐ বুকপকেটেই রাখতে হয়।’
নীললোহিতের পর্যবেক্ষণশক্তি সত্যিই অসাধারণ। বড় বেশি চোখ-কান মেলে থাকে সে। তেমন খুব জড়ায় না কিছুতে। কিংবা বলা যায়, জড়ানোর মতো আর্থিক সামর্থ্যও নেই তার। কলকাতা শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় সে। দেখা হয় প্রতিদিন অজস্র মুখের সঙ্গে। সেই মুখে লেগে থাকা প্রতারণা কিংবা শুদ্ধতাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে এই যুবক। জীবনের বাইরে থেকে সে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কোনো কিছুর বর্ণনা দেয় না। কাহিনীর কথক হলেও গল্পের মধ্যেরই চরিত্র সে। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার রয়েছে আলাদা আলাদা সম্পর্ক।
গল্পের চরিত্র? এতক্ষণ তবে গল্পের চরিত্র নিয়ে কথা হচ্ছিল? তার মানে নীললোহিত নামে কেউ নেই? না, নীললোহিত কোনো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়; লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কল্পিত চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্র এতটাই রক্ত-মাংসের গড়া যে, মনেই হয় না এই নামে কেউ নেই। সুনীলের ছিল আরো দুটি ছদ্মনাম—‘সনাতন পাঠক’ ও ‘নীল উপাধ্যায়’। কিন্তু নীললোহিতের জনপ্রিয়তা কেউ ছুঁতে পারেনি। কেননা নীললোহিতের মধ্য দিয়ে নিজের একটি আলাদা সত্তা গড়ে তুলেছিলেন সুনীল। নীললোহিতকে নিয়ে লেখা সব কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র সে নিজেই। নীলু নিজেই কাহিনীটির কথক। আত্মকথার ভঙ্গিতে এগিয়ে চলে পুরো অখ্যান। তার অনেক কাহিনীতেই শোনা যায় ‘দিকশূন্যপুর’ নামে একটি জায়গার কথা। সেখানে বাস করেন অসংখ্য শিক্ষিত সফল মানুষ। তবে জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ ওই মানুষগুলো জীবনযাপন করেন একাকী। সেই জায়গাটি নিয়ে নীললোহিতের কথা : ‘যারা জীবনে কখনো দিকশূন্যপুরে যায়নি, কিংবা সে-জায়গাটার নামও শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না তারা কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার অস্তিত্বই জানা নেই, তাকে না-পাওয়ার তো কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যারা দিকশূন্যপুরে একবার গেছে, কিন্তু বারবার ফিরে যেতে পারেনি, তাদের অতৃপ্তির শেষ নেই। আমি মাঝে মাঝে সেই জায়গাটার কথা ভাবি, কিন্তু আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় দক্ষিণে, কেউ উত্তরে।’
নীললোহিত কেবল সুনীলের একটি ছদ্মনামই ছিল না, তাঁর একটি প্রিয় চরিত্রও ছিল বটে। নিজের সমস্ত কথা যেন তিনি ক্রমাগত বলিয়ে নিয়েছেন নীলুর মুখ দিয়ে। সুনীলের আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে জানা যায়, নীললোহিতের অন্তরালে থেকে তিনি নিজেকে অনেক স্পষ্ট করে স্পর্শ করতেন, ভালোবেসে চেনাতে পারতেন। তবে অদ্ভুত একটি ব্যাপার হলো, সুনীলের নীললোহিত ছদ্মনামের লেখাগুলো পড়তে পড়তে অনেক সময় পাঠকের মনে হতে পারে, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’-ই বুঝি নীললোহিতের ছদ্মনাম। আর তাই নীললোহিতের বর্ণনা ‘ইউটোপিয়া’ ঠেকে না, মনে হয় সে একেবারে ঐ চরিত্রগুলোর ভেতর থেকে কথা বলে যাচ্ছে। কথাটির সমর্থন মেলে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের একটি লেখাতে। তিনি লিখেছেন : ‘একেক সময় ধন্ধে পড়ি সুনীলের ছদ্মনাম নীললোহিত না ভাইসি ভার্সা! অর্থাৎ উল্টোটা। কারণ কী, গোটা চল্লিশ বছর ধরে কখনও কাছে থেকে, কখনও অদূর থেকে দেখে আর পড়ে এটাই বুঝলাম যে সারাটা লেখকজীবন ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একাদিক্রমে চেষ্টাই ছিল যথাসম্ভব নীললোহিত হয়ে ওঠা।’
নীললোহিত নিয়ে সুনীলের প্রকাশিত হয়েছে মোট পাঁচটি সমগ্র।ঠিক গল্প বা উপন্যাসের কাতারে পড়ে না এই বইগুলো। কেমন যেন ডায়েরির মতো করে লেখা। কখনো সংযোগ, কখনো বিচ্ছিন্নতা! যখন যা দেখেছেন, যা ভেবে উঠতে পেরেছেন, যতটুকু মনে করতে পেরেছেন তাই যেন দর্পিত প্রতিবিম্বের মতো চলে এসেছে ওই লেখাগুলোয়। নীললোহিত স্বপ্নও দেখে। অর্থহীন স্বপ্ন নয়; আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন। তাইতো হীরেনদাকে বলে তার চোখে দেখা ত্রিশ বছর পরের সমাজের কথা : “নিশ্চয়ই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তখন সমাজে এরকম শোষণ থাকবে না, প্রত্যেকের সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। কেউ কারুর উপর জোর করে মতামত চাপাবে না।” সে আশাবাদী, কারণ সে জেনে ফেলেছে যে, ‘চিকিৎসার অতীত আশাবাদী’ না হলে বেঁচে থাকার কোনো ‘পয়েন্ট’ নেই! স্বপ্নগুলো ফাঁকি দিলে নীললোহিত চলে যায় তার একান্ত সেই ‘দিকশূন্যপুরে’!”
নীললোহিতের পায়ের তলায় শর্ষে। সে যে কখন কোথায় কীভাবে পৌঁছয় সেটাও বড় কম রহস্য নয়। কলকাতার কাছেই অধুনা আমেরিকানিবাসী ঝর্ণামাসি আর রবীন মেসোর সাতমহলা গ্রামের বাড়িতে গিয়েও ভূতের সন্ধান পায় সে। নীলুর একটু দূরসম্পর্কের মাসি ঝর্ণা। বছর বছর সানফ্রান্সিসকোয় থেকে আরো সুন্দরী হয়ে ফিরেছে। ভেতরে ভেতরে ওর প্রতি নিষিদ্ধ একটা টান অনুভব করে নীলু। তাই ভূতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস না থাকলেও দিব্যি উৎকর্ণ হয়ে ওঠে সে ঝর্ণামাসির গল্পে।
“ঝর্ণামাসি প্রথমেই বললেন, এ বাড়িতে ভূত আছে।...ওপরের বাথরুমের জানলা দিয়ে পুকুরঘাটটা পরিষ্কার দেখা যায়। একটি ঘোমটা দেওয়া মেয়ে ঘাটের সিঁড়িতে খানিকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। একটু পরে সে জলে নেমে গেল একটু একটু করে, তারপর ডুব দিল, আর উঠল না। আমি তাকিয়ে রইলুম, উঠলই না!
রবীনমেসো বললেন, হোয়াট ননসেন্স! গ্রামের মেয়েরা এই পুকুরে চান করতে আসে।
ঝর্ণামাসি বললেন, কালকেও ঠিক এটাই দেখেছিলুম, ঠিক এই সময়ে। তখন আমিও ভেবেছিলুম, কেউ চান করতে এসেছে।... পরপর দু’দিন একই ব্যাপার, ডুব দিয়ে আর উঠল না।
রবীনমেসো বললেন, হোয়াট ডু ইউ মিন, আর উঠল না?
ঝর্ণামাসি বললেন, কোনও মানুষ ও ভাবে জলে ডুব দেয় না।
ভূত তো আছেই এ বাড়িতে।
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালুম।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা। অন্তত পঁচাত্তর বছর বয়েস হবে, ছোটখাট চেহারা, টুকটুকে ফর্সা রং, মাথার চুলও একেবারে সাদা। রবীনমেসোর কাকিমা।...
তিনি আমার গালে একটি হাত ছোঁয়ালেন। কী ঠান্ডা সেই হাত!”
‘গভীর রাতে দিঘির ধারে’ উপন্যাসের এই অংশটি একটু বড় করে তুলে দেওয়ার একটিই উদ্দেশ্য। জীবন থেকে গল্পে, আর গল্প থেকে জীবনে আসার যে সরল, মধুর সত্যি-মিথ্যার মিশেল নীললোহিত গড়ে তুলেছিল- তার যৎসামান্য নমুনা দেওয়া। যে-নীললোহিতের জন্মই হলো রম্যরচনায়, রম্যরচনায় আশপাশের চালচলন শব্দচিত্রে ফুটিয়ে তোলার জন্য।
শঙ্করলালের ভাষায়, “সুনীল সে ভাবে নীলুর থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারতেন বলে মনে হয় না। নিজের যে সব খেয়ালখুশি, মান-অভিমান, সুখ-দুঃখ কবিতাতেও গেল না, তাদের চালান করে দিতেন নীলুর নির্ভার ফিলোজফিতে। সেদিক দিয়ে দেখলে নীললোহিত ততটা লেখক-সুনীলের নয়, যতটা কবি-সুনীলের অল্টার ইগো, দ্বিতীয় সত্তা। সুনীলের কবিচরিত্রের কত কিছুই যে পেয়েছে নীললোহিত, সব চেয়ে বেশি করে তাঁর ভালবাসার কাঙালপনা, আর তাঁর সেরা দুই প্রেমিকা, স্বাতী ও মার্গারিট।”
বাংলা সাহিত্যের চাঁদ-সূর্য কিংবা নক্ষত্রদের পাশে নিজেকে নিতান্তই এক জোনাকি মনে করা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই ‘নীললোহিত’ নিয়ে লেখাকে সাহিত্য বলতেও লজ্জা পেতেন। কিন্তু জীবনবোধের গভীরতা আর সহজ স্পষ্টতাই হয়তো সাহিত্য। আর তাইতো পাঠককূলে বিশেষভাবে আদৃত হয়েছেন ‘নীললোহিত’ এবং এর স্রষ্টা খোদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।