শিশুদের রক্তরোগ
শিশুদের বিভিন্ন রকমের রক্তরোগ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো রক্তশূন্যতা। রক্তশূন্যতার ফলে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হবে। আজ সোমবার (০২ মার্চ ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৬২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু রক্তরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আফিকুল ইসলাম।
প্রশ্ন : শিশুদের সাধারণত কী কী ধরনের রক্তরোগ হতে পারে?
উত্তর : শিশুদের সবচেয়ে প্রচলিত রক্তরোগ হয় রক্তশূন্যতা। যাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি এনিমিয়া। শিশুদের রক্তের আরেকটি রোগ হলো রক্তক্ষরণ বা এবনারমাল ব্লিডিং। আরেকটি রোগ হলো হিমোফিলিয়া। রক্তের আরকেটি কঠিন রোগ বলে আমরা মনে করি রক্তের ক্যানসার বা লিউকোমিয়া। তবে এটি বেশ প্রচলতি নয়।
প্রশ্ন : সাধারণত রোগীরা কোন ধরনের রক্তরোগ নিয়ে আপনার কাছে আসে?
উত্তর : রক্তরোগের মধ্যে আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি এনিমিয়া। এনিমিয়া দুটি কারণ আমরা দেখি। একটি হচ্ছে আয়রন ঘাটতির ( ডেফিসিয়েন্সি) কারণে এনিমিয়া। আরেকটি বলি হিমোগ্লোবিনের ডিসঅর্ডার। এটি থেলাসেমিয়া বা থেলাসেমিয়া জাতীয় রোগ। এটি একটি বংশানুক্রমিক রোগ। আরেকটি সমস্যা দেখা যায় সেটি হচ্ছে বন উইলিব্রেন ডিজিজ। এটিও একটি প্রচলিত রক্তের রোগ। আর আমাদের বিভাগে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ রোগী ভর্তি থাকে লিউকোমিয়ার জন্য।
প্রশ্ন : আয়রনের ঘাটতি (ডিফিসিয়েন্সি) এনিমিয়া কেন হয়?
উত্তর : আয়রনের ঘাটতি শিশু এবং সন্তানসম্ভবা নারীর হয়। শিশুদের সাধারণত ছয় মাসের পর থেকে এই ঘাটতি হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে জন্মের সময়ও ঘাটতি নিয়ে জন্মাতে পারে যদি মায়ের রক্তশূন্যতা থাকে। আবার যদি অপরিপক্ব (প্রিমেচিউর) অবস্থায় ডেলিভারি হয়ে যায় অর্থাৎ অপরিপক্ব শিশু হয় তাহলেও এই সমস্যা হতে পারে। আয়রনের ঘাটতির কারণে এনিমিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো খাবার, শিশু ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাবে। যদি না খায় তখন এই সমস্যা হতে পারে। আবার যদি ছয় মাসের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্য কোনো খাবার না খায় তখনো এই সমস্যা হতে পারে। আরেকটি কারণ রয়েছে, সেটি হলো, আয়রণ রক্তের মধ্যে হিমোগ্লোবিন হিসেবে থাকে, যেকোনো কারণে যদি রক্তক্ষরণ হয় যেমন : কৃমি। যেসব শিশুরা গ্রামাঞ্চলে থাকে তাদের এই সমস্যাটা বেশি হয়। আবার অনেক সময় এই রক্তক্ষরণ রক্ত আমাশয়ের জন্য হয়। পাইলস যদি থাকে তাহলেও হয়। এসব কারণে এনিমিয়া হয়।
প্রশ্ন : কী দেখে মা-বাবা সাধারণত বুঝবে শিশুটির আয়রনের ঘাটতির জন্য এনিমিয়া হয়েছে?
উত্তর : শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে পেলোর বলি। সাধারণত যদি ছোট বাচ্চা হয়। আরেকটু বড় হলে ক্লান্তি আসে। আবার অনেক শিশুর স্কুলের পারফরমেন্স কমে যায়। অনেক মেয়ের এর ফলে খিটখিটে মেজাজ হয়ে যায়।
আবার অনেক সময় আমরা দেখি এনিমিয়া হলে হাতপায়ে পানি চলে আসে। হার্ট ফেইলিউর হতে পারে।
প্রশ্ন : মা-বাবাকে কী ধরনের পরামর্শ দেন যাতে এই ধরনের সমস্যা থেকে শিশুকে মুক্ত রাখা যায়?
উত্তর : প্রধান কারণ তো খাবারের জন্য। বুকের দুধের পাশাপাশি যেসব খাবার দিবে সেসব খাবারে যেন আয়রন থাকে। আয়রন জাতীয় খাবার যেমন : লিভার, কাঁচকলা , কচু ইত্যাদি। লাল মাংসের (রেড মিট) মধ্যে আয়রন আছে। কলা, আনার, পেয়ারার মধ্যে আয়রন আছে। এসব খাবার দিলে আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তশূন্যতা কম হবে। আর যদি মনে হয় শিশুর কৃমি আছে তাহলে কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। পায়খানা যদি কালো হয় তাহলেও এনিমিয়া হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুর যে কৃমি রয়েছে সেটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : কৃমির জন্য রক্তশূন্যতা হবে, পায়খানা অনিয়মিত হবে। একবার পাতলা পায়খানা আরেকবার শক্ত এবং কৃমির জন্য শরীরে অপুষ্টি হবে। এর কারণ ওজন কমবে, পেট বড় হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : থেলাসেমিয়ার উপসর্গ কীভাবে প্রকাশ পাবে?
উত্তর : বংশানুক্রমে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতিকে থেলাসেমিয়া বলে। একে আমরা বলি জেনিটিক ডিজিজ। আমাদের দেশে দেখা গেছে ছয় থেকে ১২ শতাংশের এই রোগ হয়। থেলাসেমিয়ায় সাধারণ হিমোগ্লোবিন অস্বাভাবিক হয়। তাই এর ফলে রক্তশূন্যতা হয়। শিশুর গ্রোথ হয় না। অনেক শিশুর পেট বড় হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থেলাসেমিয়া বেশি হলে এক বছরের মধ্যে রক্ত দেওয়া লাগে।
প্রশ্ন : চিকিৎসা কী থাকে?
উত্তর : রক্ত দিতে হবে। আয়রন যাতে শরীরে খুব বেশি না জমে সেটি দেখা। আরেকটি হলো প্রতিরোধ করা। এই রোগ সম্বন্ধে মানুষকে জানানো যদি ক্যারিয়ার থাকে তবে পরীক্ষা করা।
প্রশ্ন : রোগ বহনকারীর কী করণীয় আছে?
উত্তর : থেলাসেমিয়া একটি জেনেটিক ডিজিজ। তাই একজন বহনকারী যেন আরেকজন বহনকারীকে বিয়ে না করে। তাহলে তাদের সন্তানের থেলাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
একটি বাচ্চার যদি হয় তবে পরবর্তী বাচ্চাটিরও হবে কি না এটি পরীক্ষা করা যায়। চিকিৎসককে পরামর্শ দিতে হবে প্রতিরোধের জন্য। আর যদি হয়ে যায় তাহলে থেলাসেমিয়ার একেবারে ভালো চিকিৎসা হলো হাড়ের মজ্জা ট্রান্সপ্লান্ট।