ক্রিকেট
সেঞ্চুরি কি পারবে ইমরুলের ভাগ্য ফেরাতে?
তামিম স্টার। কারো কারো কাছে আরো ওপরে। সুপারস্টার কিংবা মেগাস্টার। অন্তত বাংলাদেশ ক্রিকেটে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে। ইনজুরিমুক্ত তামিম মানে দলে তিনি অবশ্যম্ভাবী। আর এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করলেন লিটন দাস। সাহসী ব্যাটসম্যান। টাইমিং ভালো। আগামী দিনের সম্ভাবনাময় তারকাদের তালিকায় তাঁকে রাখতে হবে। তাঁর আবার বাড়তি একটা যোগ্যতা, গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে পারেন।
তামিমের ইনজুরি না থাকলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওপেনিং কম্বিনেশন নিয়ে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা কি করত টিম ম্যানেজমেন্ট! কিংবা করতে হতো? খুব জোর দিয়ে বলা যায়, না। তামিম ইকবাল-লিটন দাস হতেন বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি। কিন্তু হলো লিটন-ইমরুল। কারণটা সবার জানা। ইনজুরি ছিটকে দিয়েছে তামিমকে সিরিজ থেকে। তামিমের ইনজুরি একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াল ইমরুলের সামনে দলে ঢোকার জন্য। তিনি ঢুকলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ওপেনিং স্লটটাও ফিরে পেলেন। তারপর যা করলেন; সেটাও এখন অতীত। খানিকটা ইতিহাস। সেঞ্চুরি করলেন। ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেললেন। প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ হলেন। সবার জানা কথাগুলো পড়তে বাহুল্য মনে হতে পারে। তবু বলা। কারণ, ইতিহাস হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের কথোপকথন।
ইমরুল-তামিম বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক সফল ওপেনিং জুটি। টেস্টের কথা বাদ দিলাম। ওয়ানডেতেও তাঁর গোটা তিনেক সেঞ্চুরি। একাধিকবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ। কিন্তু তিনি কখনোই দলের স্টার ক্রিকেটার নন! এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় তাঁর সেঞ্চুরিটা উদযাপন যতই তাঁর নবজাতকের উদ্দেশে অভিনব হোক না কেন; সেটা আলোচ্য নয়। কারণ, তিনি স্টার নন। তারকা নন। তারকারা যা করেন, তা সব সময় বাড়তি কিছু। ইমরুলের সেঞ্চুরিটা দলের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাড়তি কিছু নয়। এমন একটা ইমেজের বলয়ে বন্দি বাংলাদেশ দলের এই বাঁহাতি ওপেনার। এটাই বোধ হয় ভাগ্য।
এশিয়া কাপের মাঝপথে তাঁকে আমিরাতে উড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাও তামিমের ইনজুরির কারণে। সকালে উড়ে গিয়ে বিকেল ম্যাচ খেললেন। দলে জায়গা পেলেন মিডল অর্ডারে। অনভ্যস্ত জায়গায় ব্যাট করলেন। সত্তরোর্ধ একটা ঝকঝকে ইনিংস খেললেন। মরুর বুকে তাঁর ঝড়ো ইনিংস নিয়েও খুব একটা তাপ-উত্তাপ ছিল না। আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকার মাঠের সেঞ্চুরি! কঠিন পরিস্থিতিতে হলেও জনমানসে তার প্রভাব তেমন অন্তত দেখা যায়নি। বরং গণমাধ্যম থেকে সাধারণ মানুষের কাছে একটা প্রশ্নই বড্ড বেশি আলোচিত হয়েছে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়টা আরো সহজে এবং বড় ব্যবধানে হতে পারত। হয়তো তাই। কিন্তু হয়নি। এবং তার ব্যাখ্যা একেকজন একেক রকমভাবে খুঁজেছেন।
কিন্তু ইমরুল কায়েসের নিজের কাছে তাঁর ইনিংসের একটাই ব্যাখ্যা আছে। ‘রানে ফিরলে সেটা চালিয়ে যেতে হয়।’ আমিরাতে রান পেয়েছিলেন। ঢাকায়ও পাওয়া দরকার ছিল। ইমরুল কায়েস তারকা নন। এটা সত্যি। তবে তিনি টেকনিক্যালি যথেষ্ট ভালো ক্রিকেটার। যিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ধরনটা পাল্টাতে পারেন। এই ইনিংসেও সেটা করলেন। ১৪০ বলে ১৪৪ রানের ইনিংস, যা বাংলাদেশকে এনে দেয় ২৭১ রানের পুঁজি। ইমরুলের এই ইনিংসটা দেখে মনে হয়েছে তাঁকে মোটামুটি সব সময় গড়পড়তা ক্রিকেটারের তালিকায় রাখা হয়। বহুদিন পর যেন আবার আবিষ্কার করা গেল তিনি ভাগ্যবান! কারণ, তামিম থাকলে তার হয়তো একাদশেই জায়গা হতো না। সুতরাং তাঁর এই ইনিংসের পেছনে ‘ভাগ্য’ বড় এক ফ্যাক্টর!
তবে ক্রিকেটের এ-বি-সি বোঝা সাধারণ মানুষও মানবেন শুধু ভাগ্যের জোরে এই ইনিংস খেলা যায় না। হয়তো সুযোগ পাওয়া যায়। এ রকম একটা ইনিংস খেলার পেছনে অবশ্য অন্য কোনো কেমিস্ট্রি আছে। যেটা তিনি না বললেও কিছুটা আন্দাজ করা যায়। আর সেটা হচ্ছে নিজেকে প্রস্তুত করা। সুযোগ পেলে কাজে লাগাতে হবে এ রকম মানসিকতা। আসলে আপনার কাজ যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু ভাগ্য। ইমরুলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তাঁর সেঞ্চুরি করা ইনিংসটা সেই বার্তা দেয়।
ইমরুল নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। প্র্যাকটিস করেছেন। তামিমের ইনজুরি তাঁকে আবার একটা সুযোগ করে দেয়। তিনি বাকি কাজটা করেছেন। তবে সফল ক্রিকেটাররা প্রয়োজনমতো অনুশীলন বা প্র্যাকটিসের পাশাপাশি নিজের লক্ষ্যটাকে বাড়িয়ে নিতে হয়। ঢাকার সেঞ্চুরি চট্টগ্রামে ইমরুলের মনে আত্মবিশ্বাস জোগাতে পারে, কিন্তু স্কোরবোর্ডে নামের পাশে রান জমা তো তাঁকেই করতে হবে। ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা সেঞ্চুরিটাকে স্প্রিংবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ আর যাই হোক ইমরুলের জন্য হতে পারে না। তামিম ইনজুরি কাটিয়ে ফিরলে যেকোনো একজনকে তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হব। এটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ভবিতব্য। তাই ইমরুল বা লিটন দাসকে সিরিয়াসলি খেলতে হবে জিম্বাবুয়ে সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে। নিজেদের জায়গা ধরে রাখা বা দলে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।
ইমরুলের তুলনায় একটু বেশি আগ্রাসী লিটন। কিন্তু আগ্রসনই ক্রিকেটে সবার জন্য শেষ কথা নয়। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা পড়ে নিয়ে সেভাবে খেলতে পারাই শেষ কথা। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা মুহূর্তের জন্য ভুললেই আপনি চূড়া থেকে খাদে গড়িয়ে পড়তে পারেন। সে আপনি আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ইমরুল কায়েস হন বা এশিয়া কাপের সেঞ্চুরিয়ান লিটন দাসই হন।
চট্টগ্রামে একটু ব্যর্থ হলেই কিন্তু কথা উঠবে দ্রুত। তখন বেশিরভাগ মানুষ মনে রাখতে চাইবেন না আগের ম্যাচের সেঞ্চুরি কিংবা এশিয়া কাপের সেঞ্চুরি করা দুর্দান্ত ইনিংস। এই মনে রাখতে না পারার একটা কারণ যদি হয় দুর্ভাগ্য। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ, ইমরুলরা কেউ স্টার কিংবা সুপারস্টার নন। শুধু বাংলাদেশ কেন, ক্রিকেটবিশ্বের সব জায়গায় স্টার-সুপারস্টারদের কদর একটু বেশি। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমওয়ার্কের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে সেটা স্টারডমকে বাদ দিয়ে নিশ্চয়ই এখন ভাবা যাচ্ছে না।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।