ক্রিকেট
ইতিহাসের পাতা উল্টাতে বাধ্য করলেন মুশফিক
বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ‘গাজা’। কিন্তু তার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরে থাক, সামান্য আলোচনাও নেই কোথাও! অস্বাভাবিক!
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ বাঁচানো টেস্টের প্রথম দিনের প্রথম ঘণ্টায় মিরপুরে জার্ভিস-ঝড়। লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের টপঅর্ডার। তামিম-সাকিব নেই, অস্ফুট উচ্চারণটা হাহাকার হয়ে উঠল না! অবিশ্বাস্য!
এই অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য ব্যাপার দুটো চাপা পড়ে গেল। কারণ, ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস! সমর্থক থেকে নেতা-নেত্রী, মিডিয়া সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এক ক্রিকেটারের ওপর। মাশরাফি। বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকায় উঠে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের ‘হেভিওয়েট’ নেতাদেরও খুব হালকা মনে হলো মাশরাফির পাশে। অকল্পনীয়!
কিন্তু এই অস্বাভাবিক-অবিশ্বাস্য-অকল্পনীয় ব্যাপারগুলোকে ম্লান করে দিয়ে মিরপুরে ছোটখাটো এক ভদ্রলোক, যা করলেন; সেটা অতুলনীয়। একশ একচল্লিশ বছরের টেস্ট ইতিহাসে তিনি-ই প্রথম উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান, যিনি দুটো ডাবল সেঞ্চুরি করলেন। ইতিহাসের এক মেধাবী ছাত্র ইতিহাসের পাতায় নতুন করে নাম লেখালেন। মিরপুর টেস্টের প্রথম ইনিংসে তাঁর কীর্তির তালিকা দিতে গেলে সেটা লম্বা হয়ে যাবে। আবার কিছু না লিখলে অন্যায় হবে। মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান, যাঁর নামের পাশে টেস্টে দু-দুটো ডাবল সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের মালিক তিনি। পেছনে ফেললেন ওয়েলিংটনে সাকিবের খেলা ২১৭ রানকে। মুশফিক অপরাজিত রইলেন ২১৯ রানে। সময় আর বলের হিসাবেও বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘতম ইনিংস খেললেন ছোটখাটো এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ছাড়িয়ে গেলেন ঢাকায় অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ৫৩৫ মিনিট ব্যাটিং করার রেকর্ড। ব্যাট করলেন ৫৮৯ মিনিট। আর সবচেয়ে বেশি বল খেলার রেকর্ডের মালিকানাও পরিবর্তন হলো।
২০১৩ সালে গলে মোহাম্মদ আশরাফুল খেলেছিলেন ৪১৭ বল। মিরপুরে মুশফিক খেললেন ৪২১ বল। মিরপুরে মুশফিককে ঘিরে ইতিহাস যেভাবে হাজির হলো, বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে তার সমতুল্য আর নেই।
কিন্তু দুর্ভাগ্য মুশফিকের। তাঁকে ঘিরে মহা আবেগের যে বলয় তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেটাই হলো না! দলকে বিপর্যয় থেকে টেনে তুললেন। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন থেকে বিপন্নতা দূর করলেন। উচ্ছ্বাস যেটুকু, যা তা মুশফিকের ডাবল সেঞ্চুরি করার পর তাঁর এবং তাঁর অনুরাগীদের চোখে মুখে ধরা পড়ল! তবে ডাবল সেঞ্চুরি করার পর মুশফিক যেভাবে সেটা উদযাপন করলেন, সেটা আগামী বছর ভালোবাসা দিবসের দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন হয়ে দেখা যেতে পারে টেলিভিশনে। টিনএজার, পেশাদার, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ—সবার মনে ভালোবাসার স্মৃতি ফিরিয়ে দেবে মুশির ওই উদযাপন।
তবে ক্রিকেট নামক খেলাটায় ব্যক্তির সাফল্য উদযাপনের অনেক উপলক্ষ এনে দেয়। কিন্তু মানুষ মনে রাখে টিমের সাফল্যকে। আর এখনকার ক্রিকেট তো পেশাদার খেলার জগৎ। আর বাংলাদেশ মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এমন একটা পরিস্থিতিতে খেলছে, যেখানে সত্যিই টিম বিপন্ন। বিপর্যস্ত। সিরিজের প্রথম টেস্ট তারা সিলেটে হেরে এসেছে সাড়ে তিন দিনে। ১৫১ রানের বিশাল ব্যবধানে। এই টেস্টটা জেতার জন্যই বাংলাদেশের মাঠে নামা।
মিরপুর টেস্টে ফল কী হবে, জানি না। সেটা আগাম বলে ক্রিকেট জ্যোতিষী না হওয়া ভালো। তবে মিরপুরে মুশফিক ও মুমিনুল ক্রিকেট পৃথিবীর পুরোনো ছবিটাকে সামনে নিয়ে এলো। অভিজ্ঞতার সামনে তারুণ্য তত্ত্বও জবাবদিহি করে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। বিশ্ব ক্রিকেটলোকে বারবার সেটা দেখা গেছে। আর পোড়খাওয়া অভিজ্ঞরা বারবার ফিরে এসে সেই উদাহরণ দাঁড় করিয়েছেন। মুশফিক নিজেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেই উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছেন একবার, দুবার নয়। বারবার। তাঁর অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কখনো কিপিং গ্লাভস কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি অবিচল থেকেছেন নিজের কাজে, যাতে মর্মান্তিক পরিণতি না ঘটে তাঁর ক্যারিয়ারের। বরং এত টালমাটাল অবস্থার মধ্যেও তিনি নিজের ব্যাটিংকে সংশোধন করেছেন। পরিণত করেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন মুশফিক। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর। দেশজ ক্রিকেট ঐশ্বর্যপতিদের তালিকায় খুব ওপরের দিকে নেই তাঁর নামটা! তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ বাঁচানোর টেস্টে আপাত ভরসা আর স্বস্তির নাম মুশফিকুর রহিম।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে ক্রিকেট তারকাদের নাম। তার মাঝে মাঠের বাইশগজে ক্রিকেট শ্রমিকের জয়গানকে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন মুশফিক-মুমিনুল। বিপন্নতা কাটিয়ে তাদের পার্টনারশিপ বাংলাদেশকে নিয়ে গেল নির্ভরতার কুঠুরিতে।
মুশফিক তাঁর প্রাপ্য তারকাখ্যাতি পাননি। কিন্তু তাঁর ব্যাটসম্যানশিপের স্বীকৃতি তিনি বারবার আদায় করে নিচ্ছেন। পরিসংখ্যানকে দূরে সরিয়ে রাখুন; তারপরও মিরপুর আরো একবার সাক্ষী দেবে তিনিই বাংলাদেশের এই মুহূর্তের সেরা ব্যাটসম্যান। মিরপুর টেস্টের অপরাজিত ২১৯ রানকে বাদ দিন। এর বাইরেও মুশফিকের অনেকগুলো ইনিংস আছে, যেগুলো টুকরো টুকরো হিসেবে সাজালে তাঁর অধিষ্ঠান হবে সেরা হিসেবে।
তবে না। টেস্ট ক্রিকেটে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখানোর পর সুখের ফোয়ারায় ভেসে যেতে নারাজ ইতিহাসের মেধাবী ছাত্রটি। অবসরোত্তর জীবনে নিজের নামের পাশে ট্রিপল সেঞ্চুরিও দেখতে চান। নিজের স্বপ্নের পরিধিকে আরো একটু বাড়িয়ে নিলেন তিনি। তবে একটা ট্রিপল সেঞ্চুরির আকুলতা দিয়ে মুশফিকের ক্যারিয়ারের অন্তিম স্টেশন না খোঁজাই ভালো। মুশফিক কোনো কিছুর জন্যই ‘এক্সপ্রেস’ গতিতে ছোটেননি। তবে লক্ষ্যে অবিচল থেকে যা পেয়েছেন; তা অন্য অনেকের নামের পাশে নেই। ইতিহাস তাই বলছে। অনেক অসামান্য কীর্তি তাঁর নামের পাশে। একসময় কি এগুলো অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় মনে হতো মুশফিকের!
হয়তো বা। আবার হয়তো বা না। তবে মুশফিক মুখে বলুন বা নাই বলুন, পাহাড়ের চূড়ার পাশাপাশি সমুদ্রের তলদেশও দেখেছেন তিনি তাঁর এক যুগের ক্যারিয়ারে।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।