গল্প
অবনীলের ভালোবাসার দিন
সকালবেলা উঠে অবনীলের অনেক কাজ থাকে। যেমন খাবার গরম করা, হটবক্সে ঢোকানো। শীতে একটা উটকো ঝামেলা থাকে, যেমন স্নানের জল গরম করা। সঙ্গে সময় থাকলে আর কিছু আয়েশী কাজ। কারো দয়াপরবশ হয়ে শেখানো কফি বানিয়ে বড় মগে এক কাপ কফি, একটা সিগারেট।
এসব করতে করতে অধিকাংশ সময় অবনীলের অফিসের গাড়ি ধরা হয় না, রাইড শেয়ারিংয়ের হেল্প নিতে হয়।
দুদিন ধরে আশপাশে উৎসবের আমেজ, যেগুলো অনেক বছর ধরে অবনীলের স্পর্শের বাইরে। এবার প্রেক্ষিত ভিন্ন, আশপাশের মানুষগুলোর বাড়তি আয়োজন তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অতটুকুই।
যেমন গতকাল পহেলা ফাল্গুন গেল, চারদিকে রঙিন ললনাদের ভিড়, মাথায় ফুলেল চাকতি, দেখতে অবশ্য ভালোই লাগে। কিন্তু অবনীল অফিসেই কাটিয়ে দিয়েছে। আজ ভালোবাসার দিন, অথচ অফিসে সারা দিনে গোটাচারেক মিটিং। মানে হলো একটু যে ক্যাজুয়ালি অফিসে যাবে, তারও উপায় নেই। তাও ফেসবুকে ঢুকে একটা স্ট্যাটাস দিল অবনীল, ভালোবাসায় না থাকুক, উদযাপনে যে সে সবার সঙ্গী, তা তো বোঝাতে হবে, অন্তত আর সবার ভালোবাসায় সে আছে। অফিসের সারা দিনের মিটিংগুলো শুধু ক্লান্তিকরই নয়, পানসে আর একঘেয়েও বটে।
এর মাঝে অফিসের অপেক্ষাকৃত তরুণ মুখগুলোকে একটু উশখুশ মনে হয় কি? এর মাঝে অনীশ এসেছিল অফিসে, অবনীলের ছাত্র আর ইলেকট্রনিকসের যাবতীয় সমস্যার সমাধানদাতা। ওকে নিয়ে বের হতে হতে ঘড়ির কাঁটা ছয়টা ছুঁইছুঁই। আচ্ছা অনীশের কি ভালোবাসা দিবস নেই? জানামতে প্রেম তো করে। রিকশায় বসে অবনীল অনীশকে তার প্রেম বিষয়ে কিছু উপদেশ দিল। পাশ ফিরে অনীশকে দেখে অবনীল অবাক হয়, এ ছেলেকেই সে ক্লাস এইট থেকে পড়াত। অবনীল ভাবে, তাকে দেখেও হয়তো কেউ একথা ভাবে। আজ রাস্তায় জ্যামের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, এটাও ভালোবাসার ফল হয়তো। মাঝেমধ্যে অবনীল ভাবে, এ যান্ত্রিক শহর, দূষিত বাতাস, নোংরা চারপাশ আসলে ভালোবাসা কী, তা কি বোঝে?
অনীশকে নিয়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টার ঘুরে অতঃপর তাকে বিদায় জানিয়ে গ্রিন রোডে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়মমাফিক হাজিরা দিতে গিয়ে চেম্বারে অবনীল বিশাল তালা খুঁজে পেল। কী আর করা। নিয়মিত আড্ডায় গিয়ে কতক্ষণ সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ, সমাজ, রাজনীতি, পেশা, প্রেম নিয়ে নানামুখী অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে আর হাসিঠাট্টায় সময়টা পার করে দেওয়া যায়। দাদাকে ফোন দিতে গিয়ে অবনীল টের পেল, দাদাও বৌদিকে নিয়ে ভালোবাসায় ডুব মেরেছে। এমন হলে আকস্মিক সবকিছু ফাঁকা লাগে, শহরের ধূসরতা আরো বেশি চোখে লাগে।
অযথা আনমনে শাহবাগ পৌঁছে গেল অবনীল, উৎসবের আলো রাত ১১টায়ও পুরো নিভেনি। এক নীলাভ দম্পতি পরস্পরের কোমর জড়িয়ে টিএসসির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এ শহরে ভালোবাসার এমন প্রকাশ এখনো বড্ড বেমানান। ফুলের দোকানগুলোর ব্যস্ততা এখনো শেষ হয়নি। নিম্নবিত্ত দম্পতিরা এ সময় ছুটে আসছে। শ্রমজীবী স্বামী ও তার স্ত্রীর মাথায় ফুল গুঁজে দিচ্ছে। শখানেক গজ দূরে বোরকা পরা এক নারীর মাথায় ও ফুলের চাকতি, একটু কাছে আসতে অবনীল টের পেল তিনি একজন মধ্যবয়স্ক নারী, প্রৌঢ় স্বামী যাকে বাইকে করে শাহবাগ নিয়ে এসেছে। চারুকলার বিপরীতে ছোট দুই শিশু পরস্পরের মাথায় কারো ফেলে যাওয়া নষ্ট মলিন ফুলের চাকতি পড়িয়ে দিচ্ছে। তার কিছুদূরে মলিন কাপড়ের এক মহিলা তেমন এক চাকতি পড়ে রাস্তার ফুটপাতে বসে আছে। হয়তো খদ্দেরের অপেক্ষায়, কিংবা কোনো এক দূরসময়ে তাকে ফেলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটার কথাই সে ভাবছে।
সব পাখিই ঘরে ফিরে, ঠিক বা ভুল। অবনীল টের পেল, ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁইছুঁই, তার মতো আটপৌরে মানুষের ঠিকানা ভুলতে নেই। রিকশা থামিয়ে মধ্যবয়স্ক চালককে পঞ্চাশ টাকা বলতে গজগজ করতে করতে রাজি হলো। চুপচাপ থাকার চেয়ে অবনীল রিকশাওয়ালার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা শ্রেয় মনে করল। ‘কাকা, আজ ইনকাম তো ভালো হলো?’ রিকশাওয়ালা ঘুরে তাকাল, একটু পর উত্তর এলো, ‘আইজ সারা দিন ভার্সিটি ঢুকতি পারি নাই।' একটু পর বলল, ‘সব নষ্ট অই গেছে, সামনে গেলে দেইখবেন সব বিয়ারের বোতল।'
অবনীল হাসে, ‘নাহ, আপনার ভুল হইছে, সব কি একি হয়?’ রিকশাওয়ালা কাকা আবার পেছন ফিরল, কেমন জানি বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল, ‘পঁচিশ বছর রিকশা চালাই, মানুষ আপনি বেশি চিনেন না আমি? ওই দেহেন। গাঁজার গন্ধ টের পান? পোলামাইয়া একসাথে বসে খায়।' অবনীল একবার উত্তর দিতে গেল, পরে ভাবল চশমার ফ্রেমে একেকজন পৃথিবীকে একেক রঙে দেখে, এক বয়সে সে রঙ চোখে সেট হয়ে যায়, যতই চেষ্টা করা হোক, তা আর পরিবর্তিত হয় না।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে অবলীল জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা, ছেলেমেয়ে কয়টা?’ এবার ঘাড় না ঘুরিয়ে উত্তর এলো, ‘দুই মাইয়া, পোলাডা তিন বছর আগে মারা গেছে, সকালবেলা হার্ট অ্যাটাক। বাঁচাওনের টাইম পাই নাই।' অবনীল কথা খুঁজে পায় না। বৃদ্ধ হঠাৎ পেছন ফিরে আচমকা কিছুটা অবাক করে মোবাইল এগিয়ে দিল, ‘পোলাডার ছবি দেহেন, চব্বিশ বছর বয়স আছিল।' অবনীল মোবাইল স্ক্রিনে গালভাঙা খোঁচাখোঁচা দাড়ির এক অল্পবয়স্ক ছেলেকে খুঁজে পেল, হয়তো মাদক কেড়ে নিয়েছে তাকে, বৃদ্ধ হয়তো তাই সব জায়গাতে মাদক খুঁজে পান। অবনীল ভাবল, পৃথিবীকে দেখার চোখ আমাদের প্রয়োজন, অভাব, ক্ষোভ, ঘৃণা বা ভালোবাসা থেকেই সৃষ্টি হয়। বাসার গলির সামনে পৌঁছে রিকশাওয়ালাকে একশ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে খুচরো ফেরত নিয়ে অবনীল দেখতে পেল দশ টাকা কম আছে।
অবনীল তাকে মনে করিয়ে দিলেও সে গা করল না। অবনীল ঠকতে পছন্দ করে না। রাগে সে বলল, ‘নেন, পুরা একশই রাখি দেন।' তাকে অবাক করে দিয়ে রিকশাওয়ালা বাকি টাকা বোতাম খোলা শার্টের পকেটে রেখে রিকশা টেনে সামনে চলে যেতে লাগল। অবনীল অবাক চোখে চেয়ে রইল। শেষে গলির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে ভাবল বেশি না, ভালোবাসার রাতে তাকে একজন শ্রমজীবী আধপাগলা ছেলেহারানো মানুষই না হয় ঠকাল। কতজন ঠকিয়ে ও কত প্রাপ্তি নিয়ে দিব্যি সুখে আছে, এ মানুষের এমন ঠকানোতে কার কতই বা ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে।
অবনীল মনে মনে আওড়ায় :
যত ভেসে যাই কবিতার কাছাকাছি, তত মনে হয় একঘেয়ে বেঁচে আছি।
কেন বসে থাকি জানালার মতো খোলা? কেন ঘড়ি ডাকে আমি ভাবি হরবোলা?
কত খোপে ভাগ করা আছি আমি জানি না, কাকে যেন ডাকি।
কার বাড়িঘর অক্ষত? আমায় তুমি নিয়ে চল…
পুনশ্চ পরদিন রাস্তার ডিভাইডারে একটা পাতাবিহীন শিমুলগাছে টকটকে শিমুল ফুল ধরতে দেখা যায়। একটাও পাতা নেই, শুধু রঙিন ফুল।