বিশ্বকাপ ক্রিকেট
জয়ই হবে ঈদ আনন্দ
ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফিকচার দেখার পর আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।ফরম্যাটের কারণে এবার সবাইকে সবার বিপক্ষে খেলতে হবে। তার মানে সব দলের কমপক্ষে ৯টি ম্যাচ খেলার সুযোগ থাকছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম তিনটি ম্যাচই টুর্নামেন্টের তিন ফেবারিটের বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকা, এরপর নিউাজিল্যান্ড এবং তৃতীয় ম্যাচ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। শঙ্কাটা ছিল, প্রথম তিন ম্যাচেই হেরে গেলে বাংলাদেশের মনোবল তলানিতে চলে যেতে পারে। যাতে পরে সহজ দলের সাথেও নিজেদের পারফরম্যান্স ফিরে পেতে নাও পারে। অনেকে বলতে পারেন, ফিকচারের ওপর তো আর কারো হাত নেই। দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ আর ক্রিকেট বিশ্বকাপ এক নয়। এটা যদি ফুটবল বিশ্বকাপ হতো, আমি নির্দ্বিধায় মেনে নিতাম। কিন্তু ফিফা আর আইসিসির সততা ও সক্ষমতায়ও যোজন যোজন ফারাক। ফিফা যেমন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ফিকচার সাজায়, আইসিসি তেমন নয়।
আইসিসিকে নিয়ন্ত্রণ করে তিন মোড়ল ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। এর মধ্যে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ভারতে লোক বেশি, বাণিজ্য বেশি; তাই ভারত যা বলে আইসিসি তাই শোনে। বাণিজ্যিক কারণে হলেও আইসিসি চায়, ভারত বিশ্বকাপে যতদূর সম্ভব টিকে থাকুক। এর জন্য তারা দৃশ্য-অদৃশ্য, ন্যায়-অন্যায় অনেক কিছু করে। এবারও শুরু থেকেই ভারতের জন্য কোমর বেধে নেমেছে আইসিসি। ভারতের প্রথম ম্যাচ খেলার কথা ছিল ২ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। কিন্তু আইপিএল খেলে ক্লান্ত ভারতের খেলোয়াড়দের ধকল সামলানোর সুযোগ দিতে ভারতের ম্যাচ পিছিয়ে দেয়া হয়। বিশ্বকাপ মাঠে গড়িয়েছে ৩০ মে। আর ভারত মাঠে নামবে ঠিক ৭ দিন পর ৫ জুন। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত দক্ষিণ আফ্রিকা খেলতে নামবে তরতাজা ভারতের বিপক্ষে। খেলোয়াড়রা শুধু আইপিএল’এর ধকল সামলে ওঠারই সুযোগ পায়নি, দলও পেয়েছে ইংলিশ কন্ডিশনের সাথে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ। আর অন্য সব দলের খেলা দেখে, পিচের অবস্থা দেখে, আবহাওয়া দেখে পরিকল্পনা করার দল সাজানোর সবচেয়ে বেশি সময় পেয়েছে ভারত। বড় দলকে সুবিধা দিতে গেলে ছোট দলগুলোকে চাপে রাখতে হয়। সেই চাপটা এবার গেছে বাংলাদেশের ওপার দিয়ে।
কিন্তু নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে সেই চাপকে উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ, আশঙ্কাকে বদলে দিয়েছে সম্ভাবনায়। প্রথম ম্যাচে ফেবারিট দক্ষিণ আফ্রিকাকে হেসে খেলে হারিয়ে দারুণ শুরু করেছে বাংলাদেশ। প্রথম তিন ম্যাচেই তিন ফেবারিটকে মোকাবেলা করা নিয়ে যে সংশয় বা ভয় ছিল; প্রথম ম্যাচেই তা উড়িয়ে দিয়েছে দূর আকাশে। এক ম্যাচেই বাংলাদেশের গায়ে এখন ফেবারিটের তকমা। আজ দ্বিতীয় ম্যাচে সেই তকমার ওজন বইবার সামর্থ্য প্রমাণের সুযোগ। বাংলাদেশ এখন আর ছোট দল নয়। রাজনীতি বিবেচনায় ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বিশ্ব ক্রিকেটের মোড়ল হলেও পারফরম্যান্স বিবেচনায় বাংলাদেশকে বাইরে রাখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এখন সবার সাথে সমানে সমানে সমানে খেলে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে ভারতের একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ‘আপসেট’ বললেও বাকি ক্রিকেট বিশ্ব কিন্তু একে আপসেট বলছেন না। বরং সবাই বলছেন যোগ্য দল হিসেবেই বাংলাদেশ জিতেছে। প্রথম ম্যাচের পর সবাই মানছেন বাংলাদেশই এই বিশ্বকাপের ডার্ক হর্স। যারা একসময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো; তাদের মুথেই এখন বিশেষণের পর বিশেষণ। এ আমাদের অর্জন, আমাদের গৌরব।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়। এই সময়ে তথাকথিত বড় দলগুলোকে বাংলাদেশ নিয়মিতই হারিয়েছে। এই যে আজ বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামবে, এই নিউজিল্যান্ডকে কিন্তু একাধিকবার হোয়াউটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ।
আজ বুধবার বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। কিন্তু এবার ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে গেছে দুদিন আগেই। রোববার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর বাংলার ঘরে ঘরে ছিল ঈদের আনন্দ। আজ সেই আনন্দের পূর্ণতা পাবার দিন। সেই ওভালেই আজ বাংলাদেশ মাঠে নামবে দ্বিতীয় ম্যাচে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে যে আনন্দের শুরু, নিউজল্যান্ডকে হারিয়ে তা আরো রং পেতে পারে। তবে বাংলাদেশ সব ম্যাচ জিতে যাবে, এমন প্রত্যাশা করলে আপনি হতাশ হবেন। আমি কখনো বাংলাদেশ দলের জয় চাই না। আমি চাই বাংলাদেশ মনের আনন্দে নিজের সেরাটা খেলুক। খেলায় হারজিত আছেই। বাংলাদেশ কোনোদিন জিতবে, কোনোদিন হারবে। কিন্তু হারার আগেই যেন হেরে না বসে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৩০ রান করেও হেরে যেতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু সে পরাজয়ে কোনো গ্লানি থাকতো না। বাংলাদেশ এখন সেই মানে পৌছেছে, খেলার আগেই কাউকে ভয় পায় না।
নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বলেছিলেন, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ একটি ম্যাচ জিতবে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। প্রথম ম্যাচেই ম্যককালামকে ভুল প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ। আজ জয় চাই, চাই ম্যাককালামের দলকে হারিয়েই ম্যাককালাসেমর জবাব দিক বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে আজ ঈদ। ইংল্যান্ডে ঈদ হয়ে গেছে কালই। তবে সেভাবে ঈদ উদযাপনের সুযোগ ছিল না খেলোয়াড়দের। খেলোয়াড়রা নামাজ পড়েছেন। দলের সবার মধ্যে তুমুল আত্মবিশ্বাস। আর মাশরাফী বলে দিয়েছেন, ‘খেলাই আমাদের ঈদ। জয়ই হবে ঈদের আনন্দ। ‘ আমরাও অধীর আগ্রহে বসে আছি জয় দিয়ে ঈদ করবো বলে। তবে আজকের প্রতীক্ষাটা একটু বেশি। খেলা শুরু হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আমাদের ঈদ পূর্ণতা পাবে ওভালে, দুদিন আগে যেই মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছি।
সবার জন্য ঈদ মোবারক
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক