ফিলিস্তিনের সমকালীন কবিতা
মুনির মাজেদ
জেরুসালেম
ওহে জেরুসালেম,
সৃষ্টির শুরুতে এখানেই
আপনার সূর্যের নিচে
জান্নাতের শিশির আর মাটির সুঘ্রাণে
গোসল করেছিলেন ফেরেশতারা।
[মুনির মাজেদ : নির্বাসিত ফিলিস্তিনি। শরণার্থী হিসেবে রোমানিয়া থাকেন। আরবি ও ইংরেজি—দুই ভাষায়ই লেখালেখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শত ছাড়িয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করা এই কবিকে মুক্তচিন্তার কারণে জর্ডান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।]
রেমি কানাজি
গাজার জন্য কবিতা
মৃত্যু চিনতাম না;
যদি না রিফিউজি ক্যাম্পে বোমা বর্ষণ না দেখতাম।
কাটা হাত-পা, মুণ্ডু, কবন্ধে
গর্ত ভরাট। মুখ নেই,
শুধু কান্না মুছে যাওয়ার ছাপ রয়ে গেছে।
ব্যথা কী, এটা বুঝতামই না;
যদি সাত বছরের মেয়েটা
আমার হাত আঁকড়ে ধরে
নরম বাদামি চোখে
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করত।
আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।
শুধু শ্বাস বন্ধ করে
শুষ্ক কলমটা পেছনের পকেটে রেখেছি;
ওটা কোনো সিদ্ধান্ত লেখা বা
কোনো কিছু বোঝার যোগ্যতা হারিয়েছে।
মেয়েটির অন্যহাতে একটা চাবি;
দাদিমার বাড়ির। কিন্তু আমি
কারাগারের দরজা খুলতে পারছি না
যেখানে তার ভাইরা আটকে আছে।
ওরা চিৎকার করছে—
'আমরা স্বপ্ন ছুড়ে দিয়েছি, যাতে অন্যপ্রান্তে পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়!'
এক মিস্ত্রি বাড়ি বানাচ্ছে
এমন এলাকায়, যেখানে সবাই বাড়ি-ছাড়া।
সেও পড়ে গেল, নিশব্দে!
একটা বুলেট তার কণ্ঠনালি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল।
দেয়ালের খুব কাছাকাছি
হাতুড়িটাও অবশ্যই একটা অস্ত্র।
পাহাড়ি বসতি আর জনমিতির অবৈধ বিস্তারে
সে নিজেও একটা অস্ত্র।
তাই তার মেয়ে গণিত পড়ছে :
৭টি বিস্ফোরণ x ৮টি মৃতদেহ = কংগ্রেসের ৪টি সিদ্ধান্ত।
৭টি অ্যাপাচে হেলিকপ্টার x ৮টি ফিলিস্তিনি গ্রাম = নিরকতা ও দ্বিতীয় নাকবা গণহত্যা।
আমাদের জন্মহার - তাদের জন্মহার = একটি সাগর ও ৪শ গ্রামের পুনর্নির্মাণ।
একটা রাষ্ট্র + দুটি মানুষ ...
আর মেয়েটা কান্না থামাতে পারল না।
বিপ্লব না চিনে
অথবা না জেনে আসল সমীকরণ;
অশ্রু ঝরছে
সাদা কাগজেই উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে আঙুল।
শিক্ষক আকাশে আদমসুরত খোঁজেন
সেটাও মিলিয়ে যায়,
নরকের আগুন নিয়ে আসা রকেট হামলায়।
বাবাকে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরার স্মৃতি
হাতড়াচ্ছে মেয়েটা। এখন সে,
কুয়া থেকে নোংরা জল তোলে।
এদিকে বসতি দখল হয়েছে, ভাগ হয়েছে।
আর তার বাবার হত্যাকারী
ইউরোপিয়ান স্বজাতির সাথে
সাগর সৈকতে বসে আছে।
এটা আমাদের মাটি, বলেই ফেলল
সাত বছরের মেয়েটা।
'এটা আমাদের মাটি।'
তার ইতিহাস বইয়ের দরকার নেই
দরকার নেই ক্লাস টিচারেরও।
তার এই দেয়াল আছে, আছে আকাশ!
আর তার রিফিউজি ক্যাম্প।
আসল সমীকরণ মেয়েটা জানে না,
তবে আমার শুষ্ক কলম দেখেছে।
আমার জবাবের অপেক্ষায় না থেকে
দাদিমার চাবি হাতেই
কালি খুঁজতে বেরুল মেয়েটা।
[রেমি কানাজি : জন্ম ১৯৮১, নিউইয়র্ক। বাবা-মা ফিলিস্তিনি শরণার্থী। ইসরায়েলবিরোধী সক্রিয় কর্মী। ইংরেজিতে লেখালেখি করেন। কবি হিসেবে আরববিশ্ব পরিচিত।]
রোস শোমালি
অস্ত্রবিরতি
প্রতিটি যুদ্ধের পর
আবারও নির্মাণযজ্ঞ!
ধ্বংসস্তূপ ফুঁড়ে আবারও
আশাবাদী নতুন কনস্ট্রাকশন!
আবারও!
সুবিন্যস্ত সামরিক
নৃশংস অগ্রযাত্রা। ধ্বংসপুরাণ।
মৃত্যুখেকো যুদ্ধে কেঁপে ওঠে মরুগ্রাম,
গোগ্রাসে গিলে খায়
স্বাভাবিক জীবনযাত্রা!
আত্মজিজ্ঞাসা
‘নিজেকেই প্রশ্ন করলাম;
কোনটা ভালো—শুরু নাকি শেষ?
দুর্ঘটনা বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো
আশ্চর্য অবস্থানে
প্রতিটি উত্তর দুলছে;
আনন্দ-বেদনার জটিল সমীকরণে!’
দৃষ্টি
নীরবতার দেয়ালে প্রজেক্ট করা
আমাদের সব ইভেন্টে চোখ।
পাখিটার বাসা একই জায়গায় আছে।
এরপরও আমরা বুঝছি না
কেন মৃত্যু সূর্যের আলো থেকেও পরিষ্কার?
[রোস শোমালি : ফিলিস্তিনের রামাল্লা শহরে থাকেন। খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসী আরব। ফেসবুকে আমার সাথে প্রায় বছর পাঁচেকের যোগাযোগ। কবি হিসেবে আরববিশ্বে জনপ্রিয়।]
নাথালে হান্দাল
গাজা
একদা এক ছোট্ট উপত্যাকায়
কালো গর্তগুলো হৃদয় গিলে ফেলছে।
আর এক শিশু আরেকটা বলল,
দম ছেড়ে দাও বন্ধু;
যখন আর স্বপ্নভূমিতে
রাতের বাতাস থাকছেই না।
গাজাবাসী
বেঁচে থাকার আগেই মরেছি আমি
একদা কবরের মধ্যেই থাকতাম।
এখন শুনলাম, সব মৃত্যু ধরে রাখার জন্য
এটা যথেষ্ট নয়।
ছোট পা
এক মা আরেকজনের দিকে তাকালেন।
চারপাশে ছোট ছোট মৃতদেহ
পোড়া বা অঙ্গছেদে
ছড়ানো ছিটানো লাশের সাগর।
মা প্রশ্ন ছুড়লেন,
বলো কীভাবে আমরা শোক পালন করব?
[নাথালে হান্দাল : ঈসা (আ.) যে বেথলেহেমে জন্মেছিলেন, সেই পবিত্রভূমির সন্তান নাথালি হান্দাল। যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী ফিলিস্তিনি এই কবি ফ্রান্স ও লাতিন আমেরিকায় বেড়ে উঠেছেন, পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর তিনটি ছোট ছোট কবিতা Gaza, The Gazans এবং Tiny Feet-এর বাংলা]