‘অ্যাকসিডেন্ট তো হয় নাই’
নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ অবতরণ করার সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়েছে। এর ফলে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বন্ধ ছিল কয়েক ঘণ্টা। এতে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও যাত্রীরা বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘অ্যাকসিডেন্ট (দুর্ঘটনা) তো হয় নাই। ওই বিমানটা ঢাকা এসে আবার চট্টগ্রাম গেছে।’
ইউএস বাংলার গণমাধ্যম শাখার কর্মকর্তা শেখ সাদী শিশির আজ সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ উদ্ধার করার পর সেটি আবার ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘রানওয়ে থেকে ছিটকে বিমান কি টিকে থাকে? ফেরত আসে কীভাবে। এটা আসলে প্রোপাগান্ডা। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার গেছে এবং তারা চাকা ঠিক করে তা ফেরত নিয়ে এসেছে।’
সাদী বলেন, ‘সৈয়দপুর রানওয়ে ছোট। আর রানওয়েতে নামার পর তা সামান্য ঘাসের ওপর চলে যায়। চাকা উঠিয়ে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকা এসেছে। বিমান রানওয়েতে ছিল। সেখান থেকে ঘাসে চলে গেছে। তবে ঘাস নরম হওয়াতে চাকা দেবে গেছে।’
ঘাসে নেমে গেলে তা বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত কি না-এমন প্রশ্নে সাদী বলেন, ‘বড় একটা দুর্ঘটনা না। আর ছিটকে যায়নি। এই কথার কোনো অর্থ নেই। কারণ ছিটকে গেলে উড়োজাহাজ ফেরত আসতে পারে না।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক এমডি ও সিইও ড. এম এ মোমেন বলেন, ‘এটা ভালো উড়োজাহাজ। তবে ছিটকে গিয়ে থাকলে কয়েকটা কারণে হতে পারে। উড়োজাহাজের মেইনটেইনেন্সে সমস্যা থাকতে পারে। আরেকটা হতে পারে রানওয়ে পিচ্ছিল ছিল কি না। আর যথাযথ জায়গা থেকে ল্যান্ড করেছিল কি না সেটাও জানা প্রয়োজন। কারণ যথাযথ অবস্থান থেকে ল্যান্ড করা না হলে বা সামনে থেকে ল্যান্ড করলে টারমার্কের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে চলে যাবে উড়োজাহাজ।’
উড়োজাহাজ সংস্থাটির দাবি ‘এটা কোনো বিষয় না’-এ প্রসঙ্গে ড. মোমেন বলেন, ‘এটা অবশ্যই বিষয়। এতগুলো মানুষের জীবন এর সাথে জড়িত।’
সকালে দুর্ঘটনার শিকার ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজটি আজ বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা ফিরে এসেছে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম রেজাউল করিম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ মডেলের উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হতে হয় এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৮০০ মিটার। আর প্রস্থ কমপক্ষে ৪৫ মিটার। পাশাপাশি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় রেসকিউ অ্যান্ড ফায়ার ফাইটিং (আরএফএফ) যান থাকতে হয় দুটি। এ নির্দেশনা আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও)। দেশের তিন বিমানবন্দর বরিশাল, রাজশাহী ও সৈয়দপুরে এসব মানদণ্ড পুরোপুরি না থাকলেও ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
প্রয়োজনের তুলনায় ছোট এসব রানওয়েতে ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের অবতরণ ও উড্ডয়ন ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বরিশাল, রাজশাহী ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়ের প্রস্থ প্রয়োজনের তুলনায় ১৫ মিটার কম। ফলে ঘন কুয়াশা, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এমনকি আকাশে মেঘ বেশি থাকলে এ ধরনের উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে পারেন বৈমানিকরা। এ অবস্থায় রানওয়ে থেকে উড়োজাহাজ ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি বিমানবন্দর তিনটিতে আরএফএফ যান কম থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের হতাহতের আশঙ্কাও বেশি। কারণ ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের যাত্রী পরিবহনক্ষমতা ৭৬ জন। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটলে এত সংখ্যক যাত্রী উদ্ধারের সক্ষমতা নেই বিমানবন্দর তিনটির। আইকাও পরিদর্শনে বিষয়টি সামনে এলে সংকটে পড়তে পারে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এতে আবারও কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কর্তৃপক্ষের।
বেবিচকের তথ্যানুযায়ী, বরিশাল বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৮২৯ মিটার হলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার। দুর্ঘটনা মোকাবিলা অর্থাৎ অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে বিমানবন্দরটি তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত। এতে উদ্ধারযান রয়েছে মাত্র একটি এবং উদ্ধারক্ষমতা সর্বোচ্চ ৪৮ জনের। এ ছাড়া অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও নেই বিমানবন্দরটিতে।
আরেক বিমানবন্দর সৈয়দপুরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৮২৯ মিটার হলেও প্রস্থ মাত্র ৩০ মিটার। অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে বিমানবন্দরটি চতুর্থ শ্রেণিভুক্ত, যেখানে আরএফএফ যান রয়েছে একটি। একইভাবে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য এক হাজার ৮০১ মিটার ও প্রস্থ ৩০ মিটার। এ বিমানবন্দরও অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সক্ষমতার দিক দিয়ে চতুর্থ শ্রেণিভুক্ত।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক এমডি ও সিইও ড. এম এ মোমেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোট। এই বিমানবন্দরে ড্যাশ-৭-কিউ-৪০০ পরিচালনা কোনোমতেই যুক্তিসংগত নয়। বাংলাদেশ বিমানও এই কিউ-৪০০ পরিচালনা করছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো বিমানবন্দর কিউ-৪০০ উড়োজাহাজের উপযোগী না। কারণ এই উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা সাশ্রয়ী।
এই বিমানবন্দরে কোন ধরনের উড়োজাহাজ পরিচালনা করা যাবে জানতে চাইলে ড. মোমেন বলেন, ড্যাশ-৮ চালাতে পারে। কিন্তু যেহেতু কিউ-৪০০ না হলে কর্তৃপক্ষের পোষাবে না, তাই রানওয়ে বড় করতে হবে।
প্রসঙ্গত, কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ ৭২ আসনের, অপরদিকে ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ ৫০ আসনের।
ড্যাশ-৮-কিউ-৪০০ সৈয়দপুর বিমানবন্দরে পরিচালনা করার উপযোগী কি না-এ প্রসঙ্গে ইউএস বাংলার কর্মকর্তা শেখ সাদী শিশির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সবকিছু নেওয়া আছে। না থাকলে সিভিল এভিয়েশন অনুমতি দিল কীভাবে?’