গরুর মাংস আমার আর ভগবানের একান্ত বিষয়
গরুর মাংস খেয়েছে সন্দেহে দাদ্রির (উত্তর প্রদেশের এক শহর) সেই লোকটিকে হত্যা করার পর থেকেই আমি আমার এই গল্পটির কথা ভাবছি। ভাবছি বছর বিশেক আগে আমার সঙ্গে কী ঘটেছিল সেই অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায় কি না। আমার চারপাশে দেখছি মানুষজন কেমন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। দেখছি কীভাবে আমাদের খাওয়ার প্লেট এখন রাজনীতির খোরাক হয়ে উঠেছে। এই কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমি গরুর মাংস খাই না; ফ্রিজে সংরক্ষণও করি না। এই ঘোষণার ফলে আশা করছি আমাকে আর বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে রাজপথে এনে হত্যা করা হবে না। ইনশাল্লাহ, নতুন কোনো ইস্যু তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকব।’
আমি আমার এই বন্ধুটিকে পছন্দ করি। তাঁকে জানাতে চাই, এই ভয়ে ভীত সে একা নয়। আমরাও আছি। আমি তাঁর স্ট্যাটাসে লাইক দিয়ে বা কমেন্ট করে সমবেদনা জানাতে পারতাম। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয় বলে আর করিনি। বরং আমি আমার জীবনের এই গল্পটি শেয়ার করা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করছি। গল্পটা অনেকটা এ রকম- কোনো এক শনিবারে আমার ধার্মিক ভেজিটেরিয়ান বাবা-মা মন্দিরে যাওয়ার আগে ভোজে আমি ভুল করে তাদের প্লেটে গরুর মাংস তুলে দিয়েছিলাম।
ঘটনাটা ঘটেছিল আমরা স্বপরিবারে বছর তিনেকের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলাম, তখন। আমরা লন্ডনে পৌঁছানোর প্রথম সপ্তাহে শহরটি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর রেস্টুরেন্টগুলোতে এটাসেটা খাচ্ছিলাম। বাবা অভ্যেসবসত তাঁর পকেট থেকে ম্যানিবাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে খাওয়ার কিছু একটা আনতে বললেন। আমি বার্গার অর্ডার করলাম। আমরা টেবিলে অপেক্ষা করছিলাম, বার্গার এলো। আমি খুউব মনে করতে পারছি, যে মুহূর্তে বার্গারে আমি কামড় বসাতে যাব তখনই চোখে পড়ল, মোড়কে স্পষ্ট করে লেখা, ‘শতভাগ বিফ’! আমি সহসা বাবা-মায়ের দিকে তাকালাম। যা ভয় করেছিলাম তাই হলো, তাঁরা তখন প্রথম কামড়ের পর দ্বিতীয় কামড় বসাতে যাচ্ছিলেন।
কীভাবে এটা ঘটল? আমি না চিজবার্গার বললাম! মেন্যুর কোথাও তো বিফ বার্গারের কথা উল্লেখ ছিল না; তাহলে? যাঁরা এর আগে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তাঁদের মুখে এই রকম ভীতিকর ঘটনার কথা শুনেছি। আমি আর খেতে পারছিলাম না-আমার বাবা-মা যেটা পাপ বলে মনে করেন, সেটা তাঁরা করছেন, এবং আমার কারণেই। আমি তাঁদের থামিয়ে দিতে পারতাম, যাতে তাঁরা ভারতে ফিরে গঙ্গাজল দিয়ে মুখ ধুয়ে পবিত্র হতে পারেন। আমার বাবা-মা ভীষণ বিশ্বাসী মানুষ। সকালে পূজা না দিয়ে বাড়ির বাইরে যান না, সন্ধ্যায় পূজার মধ্য দিয়ে বাড়িতে সান্ধ্যবাতি জ্বলে। শেষপর্যন্ত আমি আর তাঁদের থামালাম না। নিজেও খেলাম।
তারপর অনেককিছুই বাবা-মায়ের সঙ্গে শেয়ার করেছি। কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার কথা তাদের ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিইনি। সেদিন সব জেনেও বাবা-মাকে না থামানোর জন্য একটা চাপা অপরাধবোধ আমার ভেতর কাজ করছিল দীর্ধদিন ধরে। তারপর যেদিন আমার ভাইটি প্রকাশ্যে গরুর মাংস খাওয়া শুরু করল, সেদিন থেকে সেই অপরাধবোধ কিছুটা কমল। ভাইয়ের বন্ধুর মা মাঝেমধ্যে তার জন্য বিফরোস্ট পাঠাতেন। ভাই খেয়ে বাকিটা ফ্রিজে তুলে রাখতেন। দেখতাম মা হালকা করে বলছেন, ‘কী যা-তা সব খায়! মা ভালো করেই জানতেন বাটির ভেতরে কী আছে। দেখা যেত, তার পাশেই হয়তো মা ডালের বাটিটা রাখছেন। অথচ আমার এই মা শনিবার রসুন পর্যন্ত খেতেন না। মাসে পনেরো দিন টানা বাবার সঙ্গে ভেজিটেরিয়ান বনে যেতেন। নির্দিষ্ট করে বললে সেই মুহূর্ত থেকে আমি অনুভব করলাম, হিন্দু হওয়া বেশ আনন্দের বিষয়। ভগবান সবকিছু বোঝেন। তিনি ভুল করলে ক্ষমা করেন।
আমার বাবা-মা এমন বাবা-মায়ের সন্তান, যাঁরা নোংরা হওয়ার কারণে মুরগির ডিম খেতেন না, হাঁসের ডিম খেতেন। আমার সেই বাবা-মা কোনোদিন আমাদের জোর করে মন্দিরে নিয়ে যাননি। তাঁরা চেয়েছেন, তাঁদের দেখে যেন আমরা শিখি। আমার মনে হলো, হয় অনুরূপ অনুভূতি থেকে আমি আমার বাবা-মাকে গরুর মাংস খাইয়েছি।
অবশেষে এই লেখাটি লিখতে বসার আগে বাবার কাছে সেদিনের সেই ঘটনাটি খুলে বললাম। বাবা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। কেউ যদি তাঁদের জিজ্ঞেস করে, তাঁরা গর্বিত হিন্দু কি না, তাঁরা নির্দিধায় ‘হ্যাঁ’ বলে উত্তর দেবেন। খুব সম্ভবত আমিও একই উত্তর করব। আমি জানি, অনেকে হয়তো আমাদের গ্রহণ করতে পারবেন না। আমি সেটা পরোয়া করি না। এটা নিতান্তই আমি এবং আমার ভগবানের একান্ত বিষয়।
লেখক : সম্পাদক, জাতীয় ঘটনাবলি, এনডিটিভি।
এনডিটিভি ব্লগ থেকে অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন।