ক্রিকেট
মাশরাফি : দ্য লিডার
It is better to lead from behind and to put others in front, especially when you celebrate victory when nice things occur. You take the front line when there is danger. Then people will appreciate your leadership. -Nelson Mandela
প্রকৃত নেতার গুণকীর্তন করতে গিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এমন কথাই বলেছেন। আমরাও আজ এমন একজন লিডারের কথা বলব, যিনি তাঁর নেতৃত্বের গুণে ১৬ কোটি মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন এরই মধ্যে। তিনি আমাদের কৌশিক, নড়াইল এক্সপ্রেস, ম্যাশ তথা
মাশরাফি বিন মুর্তজা!
ছয় ফুট তিন ইঞ্চি গড়নের ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার; যিনি বাংলাদেশ স্বল্প ওভারের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক এবং ১৭ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ১২ ম্যাচেই জয় তুলে এনেছেন। ১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর নড়াইলে জন্ম নেওয়া এবং ৮ নভেম্বর ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষিক্ত ম্যাশ যে একজন পরিণত ক্রিকেটার তথা অধিনায়কের নাম, বিশ্বকাপ ফলাফল, পাকিস্তান বধ বা সর্বশেষ ক্রিকেট মুঘল ভারতের বিপক্ষে দাপুটে জয় তার বড় প্রমাণ।
আমাদের এই মাশরাফির গুণপনার কি শেষ আছে? হাঁটুতে সাত-আটটি অপারেশনের ধকল নিয়েও কী স্বচ্ছন্দে ক্রিকেট খেলে চলেছেন তিনি। যিনি সাহসের সঙ্গে ঝুঁকি নিতে জানেন। গর্বভরে উচ্চারণ করতে পারেন, ফরচুন ফেভারস দ্য ব্রেভ। তিনি ম্যাশ; দ্য ক্যাপ্টেন অব বাংলাদেশ। বাইকপ্রিয় মাশরাফিকে এলাকায় সবাই খুব হাসিখুশি আর উদারচেতা হিসেবেই জানে। নিজের শহরে তিনি প্রচণ্ড জনপ্রিয়। সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াকালীন পরিচিত সুমনা হক সুমিকে বিয়ে করেন ২০০৬ সালে।
এবার ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে জিতে ভীষণ খুশি মাশরাফি বিন মুর্তজা। অনেকে মেলবোর্নে ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে হারের প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন এই জয়কে। তবে তাদের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে বাংলাদেশের অধিনায়কের। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি বলেন, ‘আমি মনে করি, খেলার ভেতরে প্রতিশোধ থাকা ঠিক নয়। আমরা সবাই মানুষ। আমাদের পরিবার আছে। সবাই আমরা ক্রিকেট খেলি। এখানে প্রতিশোধের প্রশ্ন আসেই না। আমরা মাঠে অবশ্যই জেতার জন্য লড়াই করি। এতটুকুর ভেতরই থাকতে চাই। যখন মাঠে ম্যাচ খেলবেন তখন অনেক কিছু হতে পারে। আমাদের সবাই কিন্তু ম্যাচ শেষে হোটেলে একসঙ্গেই যাই; হোটেলে গিয়ে একসঙ্গে আড্ডা দিই।’
এই না হলেন আমাদের নয়নমণি মাশরাফি। যিনি শুধু একজন পরিশ্রমী বা বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কই নন; একজন মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষও বটে। নেতা হিসেবে চৌকস ও সপ্রতিভ এমন ক্রিকেটার বাংলাদেশের ইতিহাসে আর এসেছে এমনটা কে বলতে পারে? ইনজুরি কাটিয়ে এবার অধিনায়কের দায়িত্ব প্রথম দিনেই দিনে জানান দিয়েছিলেন, ‘আমি চাই না কেউ ভাবুক যে টিমে আমি ক্যাপ্টেন, বরং টিমের প্রত্যেকেই ভাবুক যে তাঁরা প্রত্যেকেই টিমের ক্যাপ্টেন। এতে নিজ নিজ দায়িত্বটা বেড়ে যায়।’ এই না হলে, সত্যিকারের ক্যাপ্টেন। অহংকার ছুঁবে কেবল কর্মকুশলতা ও তার ফলাফলে; পদ-পদবিতে নয় মোটেও!
নেতা হিসেবে যিনি দলের মধ্যে একধরনের ম্যাজিক্যাল স্পিরিট ছড়িয়ে দিতে পারেন, তিনিই যে জয়ী ম্যাচ শেষ হওয়ার পর উদযাপনেরও মধ্যমণি হবেন। সতীর্থদের আলিঙ্গন, পিঠ চাপড়ে দেওয়া, হাই ফাইভ; এসব তো কমন। অধিনায়ক মাশরাফি ছুটে এসে সতীর্থদের মাথার চুল এলোমেলো করে দেন, চুমু এঁকে দেন কপালে-মুখে। ছোট ভাইয়ের মমতায় মাশরাফি বেস্ট পারফরমাদের বুকে জড়িয়ে নেন। ‘দোলা দে’ টাইপ ড্যান্স করতে পারেন। আর তাসকিনের সঙ্গে বিখ্যাত ‘ম্যাশকিন’ উদযাপন করে ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডেই উদযাপনের ভাষা বদলে দিতে পারেন। জুনিয়রকে সুশাসন বা সোহাগ করার উদাহরণযোগ্য দক্ষতা কেবল ম্যাশের একার অধিকার। এবারের ভারতবধ শেষে শেরেবাংলার ড্রেসিং রুম থেকে সংবাদ সম্মেলনের পথে মাশরাফি ও মুস্তাফিজ। দুজনকে ঘিরে সংবাদকর্মীদের মিছিল। সবার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে অধিনায়ক বলেন, ‘আমাকে নয়, ওকে বেশি করে অভিনন্দন জানান।’
ম্যাশ গুণীর গুণকীর্তনও যথার্থ করতে জানেন। নড়াইলের উদারনৈতিক পারিবারিক আবহ মাশরাফিকে এমন অনন্যতা দিয়েছে। মাশরাফির গ্রামের বসতবাড়িটি এলাকার সবার জন্য সদা উন্মুক্ত। কেউ কখনো না খেয়ে, কিছু না নিয়ে ফিরে যাবেন এমনটা ঘটবার নয়। মানুষের আসমুদ্র অনিঃশেষ ভালোবাসা যাদের জন্য তোলা থাকে, সেই তাদের জন্য মাশরাফিদের ঘরের দরজায় কখনো কোনোদিন খিল পড়ে না। মাশরাফির প্রিয় বাবা গোলাম মুর্তজা অনন্তর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবিক বিশালতায় অবগাহন করে সুর সুধায় মন মাতান। এমন পরিবারেরই প্রিয়পুত্র মাশরাফি আজকের এই ম্যাশ হয়ে উঠবেন এ যেন ভবিতব্যই ছিল! মাশরাফি বাংলাদেশের সফলতম পেস বোলারদের একজন। আক্রমণাত্মক, গতিময় বোলিং দিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে থাকতেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাবেক ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের নজর কেড়েছিলেন, যিনি কিনা তখন দলটির অস্থায়ী বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন। রবার্টসের পরামর্শে মাশরাফিকে বাংলাদেশ এ-দলে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ এ-দলের হয়ে একটিমাত্র ম্যাচ খেলেই মাশরাফি জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ান ডে সিরিজের একটি ম্যাচে অবিস্মরণীয় জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাটকীয় জয়ে তিনি অবদান রাখেন। ২০০৬ ক্রিকেট পঞ্জিকাবর্ষে মাশরাফি ছিলেন একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় বিশ্বের সর্বাধিক উইকেট শিকাশি। তিনি এ সময় ৪৯টি উইকেট নিয়েছেন। মাশরাফি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যানও। ২০০৪ সালেই ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় তিনি পরপর চার বলে ছক্কা পেটান। সেই ওভার থেকে তিনি ২৬ রান সংগ্রহ করেন, যা কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১১ বার চোটের কারণে দলের বাইরে যেতে হয়েছে মাশরাফিকে। চোটের কারণে অপারেশন টেবিলে তাঁকে যেতে হয়েছে সাতবার। এরপরও দেশকে ভালোবেসে খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভীক এই ক্রিকেটার ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংলিশ বিজয়টাকে নিজের মাথায় লাল-সবুজ পতাকা মুড়ে নিয়ে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে উৎসর্গ করতে পারেন আমাদের আবেগি দেশপ্রেমিক মাশরাফি। এমনতর নিখাদ বাংলা মানুষ ও ক্রীড়া বিনোদনের প্রকৃষ্ট আইকন ম্যাশের অকৃত্রিম ভালোবাসায় বেঁচে থাকুক ১৬ কোটি বাঙালি। আমাদের সেই প্রিয় মাশরাফি ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমরা তাঁর আশু রোগমুক্তি কামনা করছি।
লেখক : গাজীপুর প্রতিনিধি, মাছরাঙা টেলিভিশন