প্রাণের বইমেলা
একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় মনন ও ঐতিহ্যের প্রতীক। শেষ পর্যন্ত বইমেলার উদ্বোধন হয়েছে। এটিই আপাত স্বস্তি, যারা বই রচনা এবং প্রকাশ ও বিপণনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তাদের। পাঠক তার চাহিদার বইটি কোনো না কোনোভাবে সংগ্রহে সমর্থ। তবে বলা অনাবশ্যক যে একুশে বইমেলা এমন এক অনন্য আয়োজন, যেখানে গিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করে বহু মানুষ। কেননা, এ থেকে জঙ্গম-উদ্যমের প্রেরণা মেলে। আর একটা কথা তো ব্যাপকভাবে চালু, মিলনমেলা। অস্বীকার করবে কে! এখন বইমেলাকে সফল করে তোলার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? অভূতপূর্ব একটা সময়ে এবার বইমেলা হচ্ছে, আবারও করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। তাই প্রস্তুতিও হতে হবে বিশেষায়িত।
গত এক বছরে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে এসব কথা মাস্ক পরতে হবে, বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে, পরস্পর কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। জানা কথা, কিন্তু মানি কজন? বইমেলায় গিয়ে যদি আমি কোভিডে আক্রান্ত হতে না চাই, তাহলে মেলায় আগত শতভাগ মানুষকেই এগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। আমরা আন্তরিক ও সচেতন আছি তো? করোনাকালে বইমেলার সফলতা নির্ভর করবে মেলার আয়োজক, অংশগ্রহণকারী, সর্বস্তরের সার্বক্ষণিক কর্মী এবং মেলায় আগত প্রত্যেকের আন্তরিকতা, দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতার ওপর। সারাক্ষণ এটি স্মরণে রাখা চাই যে মেলার স্টলের একজন বিক্রেতাও যদি অসুস্থবোধ করেন, তাহলে তিনি মেলায় আসা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। একইভাবে কোনো দর্শক/ ক্রেতাও যদি অসুস্থ থাকেন, তবে তিনিও মেলায় আসবেন না। এখন জ্বর বা বহুল উচ্চারিত করোনার উপসর্গগুলোর যেকোনো একটিকেও সন্দেহের চোখে দেখতে হবে এবং ঘরের বাইরে, বিশেষ করে জনসমাগমের স্থানে উপস্থিত হওয়া চলবে না অন্যদের কল্যাণ নিশ্চিতে।
১ ফেব্রুয়ারিতে যথানিয়মে বইমেলা আরম্ভ না হওয়ায় সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছিলেন প্রকাশকেরা। কারণ, এটি তাদের জীবিকার সঙ্গে জড়িত। সমাজে এখনও যথাযথভাবে বই বিতরণ ও বিপণনব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় মাসব্যাপী একুশে বইমেলার বই বিক্রির ওপরই তারা অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে আমরা যতই জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যববস্থা গড়ে তোলার কথা বলি না কেন, এখনও দেশের মানুষের ভেতর পাঠাভ্যাস তেমন গড়ে ওঠেনি। বিষয়টি বইমেলার উদ্বোধক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব ভালো করেই জানেন বলে ১৮ মার্চ বিলম্বিত বইমেলা উদ্বোধনকালে পাঠক তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন। নতুন প্রজন্মে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে তাদের উৎসাহ দানের কথা বলেছেন। তবে সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতেই হবে যে শিক্ষাজীবন শেষে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তাই সামাজিক আন্দোলনই এখানে বেশি কার্যকর হবে। নবীন-তরুণদের ভেতর বই পড়ার আনন্দ একটা নেশার মতো যদি করে তোলা সম্ভব হয়, বই পড়ার পিপাসা তৈরি হয়ে ওঠে, তাহলে জীবনভর তারা বইয়ের ভেতরে জীবনের আনন্দ ও পরম নির্ভরতা খুঁজে পাবে। আর এ কাজের জন্যে লেখকদেরও নিষ্ঠাশীল থাকার বিকল্প নেই। মানসম্পন্ন বই রচনায় ব্রতী থাকতে হবে।
বিচিত্র বিষয় নিয়ে বিভিন্নমুখী বই রচনার সংস্কৃতি যে এখনও দেশে খুব সক্রিয় নয়, এটি দুঃখের সঙ্গে বলতেই হচ্ছে। বিচিত্র বিষয় নিয়ে ননফিকশন বা মুক্তগদ্যের বই লেখার জন্য যেমন মুক্তমনা প্রতিভাবান লেখক প্রয়োজন, তেমনই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও পাণ্ডুলিপি পরিকল্পনার জন্যও মানুষ দরকার। এসব ক্ষেত্রে যে আমাদের যোগ্য ব্যক্তির অভাব রয়েছে, সে কথা বলে আর হতাশা বাড়াই কেন। সে যাক, চলমান বইমেলার প্রসঙ্গে ফিরি। স্টলের সামনে দর্শক-ক্রেতার ভিড় নিয়ন্ত্রিত রাখার কার্যকর পন্থা কী হতে পারে, তা নিয়ে কি আমরা ভাবছি? এবারের বইমেলা যেমন আমাদের সামনে সুস্থতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসেছে, তেমনই আমরা কতটা সুশৃঙ্খল, সচেতন ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তা-ও দারুণভাবে বলে দেবে।
লেখক : সাংবাদিক