ঢাকার কথা ১৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
ঔপনিবেশিক শাসন যুগে বাংলার ইতিহাসে একটি বড় ঘটনা ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ। এই সময় বড় লাট লর্ড কার্জনের প্রস্তাবনায় বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। অর্থাৎ বাংলার বিশাল সীমারেখাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ স্থাপিত হয়। যার রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধিতা করে কংগ্রেস ও শিক্ষিত অগ্রসরমান হিন্দু নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান অনগ্রসর পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা সরকারকে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন জানায়। কারণ তাঁদের কাছে এ বিষয়টি নিশ্চিত ছিল যে একজন ছোট লাটের অধীনে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ কার্যকর হলে এ অঞ্চলের প্রভূত উন্নয়ন হবে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর থাকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে পূর্ব বঙ্গে- বিশেষ করে ঢাকায় বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। কিন্তু হিন্দু নেতৃত্ব ও হিন্দু সংগঠনগুলোর ক্রমাগত বিরোধিতা ও নানামুখী চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে। এ কারণে ঢাকার মুসলমান নেতৃত্বের মধ্যে নেমে আসে হতাশা।
উনিশ শতকে স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমীর আলী, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, নওয়াব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম সমাজ সংস্কারকদের চেষ্টায় শিক্ষার ক্ষেত্রে অনগ্রসর বাংলার সাধারণ মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব অনুভব করে। তাঁরা বঙ্গভঙ্গের কারণে নতুন প্রদেশ পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পূর্ববঙ্গে এবার শিক্ষার গতি সঞ্চারিত হবে। নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় তাঁরা তাই নিজেদের বেশ ক্ষতিগ্রস্ত মনে করতে লাগলেন। এসব প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মুসলমান নেতৃত্বের এই অসন্তোষের বিষয়টি বিবেচনায় আনেন। মুসলমানদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে শোনার জন্য ঢাকা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯১২ সালে মুসলিম নেতা নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং এ কে ফজলুল হক বড় লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা অবহিত করেন বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে পূর্ববঙ্গের শিক্ষা বিকাশের ধারা রুদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার কারণে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথে তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। এসবের প্রতিবিধানের জন্য তাঁরা বড় লাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ববঙ্গে শিক্ষা বিকাশের পক্ষে সরকারের অবস্থানের কথা জানান এবং আশ্বস্ত করে বলেন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অচিরেই ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ পাঠাবেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে থাকেন হিন্দু নেতারা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু প্রতিনিধিদল ১৯১২ সালেই লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা একধরনের বিভক্তি তৈরি করারই শামিল। তাছাড়া পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান কৃষক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তাদের কোনো কাজে আসবে না। বড়লাট প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করে জানান যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই নতুন করে বঙ্গভঙ্গের প্রক্রিয়া শুরু নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় হবে আবাসিক এবং তা সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব লন্ডনে পররাষ্ট্র মন্ত্রী অনুমোদন করেন। এ সংক্রান্ত পত্র স্বাক্ষর করা হয় ১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল। এরপর প্রকল্প তৈরির প্রস্তুতি নেয়া হয়। এই লক্ষ্যে ২৭ মে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানকে প্রধান করে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রস্তাব করে এই সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়টি শহর এলাকার কলেজগুলোকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পে ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, মোহামেডান কলেজ, উইমেন্স কলেজসহ মোট সাতটি কলেজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের একটি পরিকল্পনা ছিল ব্রিটিশ সরকারের। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল হায়াদ্রাবাদ, আলীগড়, এলাহাবাদ, বেনারস, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। জ্ঞানের নানা দিক চর্চার সুযোগ করে দেয়া ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। একারণে সাধারণ কলাবিদ্যা ছাড়াও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল , চিকিৎসাশাস্ত্র আইন ইত্যাদি বিদ্যাচর্চার প্রস্তাব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনায়।
নাথান কমিশন ১৯১২ সাল থেকেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে লেগে যায়। কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচনে রমনা এলাকাকে বেছে নেয়। আগেই সরকারের অধিগ্রহণ করা ২৪৩ একর জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত প্রস্তাব প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। এবার জনমত যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় কমিশন। ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটি অনুমোদন করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই পর্যায়ে একটি বিশেষ কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলমান নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন। এর কারণ বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে সরকার প্রয়োজনের তুলনায় একটি ছোট বাজেট পাশ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে সরকারের আর্থিক সংকটের কারণে প্রাথমিকভাবে বাজেট বড় করতে পারেনি। প্রস্তাবিত বাজেট ছিল এগার লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা।
নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মত নেতারা বিধান সভায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে এ সমস্যা সমাধান ও প্রকৃত চাহিদা নির্ণয়ের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম. ই. স্যাডলার ছিলেন এই কমিশনের প্রধান। ১৯১৯ সালে কমিশন বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়। কমিশন পরিসংখ্যান দিয়ে দেখায় সেসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ছিল ২৯, ২৯০ জন। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগ ও ত্রিপুরা জেলা থেকে যাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ৭,০৯৭ জন। তাই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ববাংলার আগ্রহী শিক্ষার্থীরা সহজেই পড়ার সুযোগ পাবে। স্যাডলার কমিশন ১৩টি সুপারিশ যুক্ত করে ১৯২০ সালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যক্ট’-এর খসড়া তৈরি করে। বড়লাট এই আ্যক্ট ২৩ মার্চ অনুমোদন করেন। এই রছর ডিসেম্বর মাসে প্রস্তুতিমূলক কাজের মধ্যদিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে। প্রথম উপাচার্য হিসেবে ১০ ডিসেম্বর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ড. জি. পে. হার্টগ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও বিরোধিতাকারীরা সুকৌশলে এর বিকাশ থামিয়ে দিতে চেষ্টা করে। প্রথমেই একটি অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরির চেষ্টা করা হয়। ভারত সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ড প্রদান করলেও বাংলার শিক্ষামন্ত্রী স্যার প্রভাস মিত্র এই টাকা প্রাদেশিক ফান্ডের সাথে মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুব অল্প পরিমাণ বরাদ্দ করেন। এমনিতেই অর্থনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের মানুষের একটি ভীতি ছিল। সরকারীভাবে ছাত্র বেতন নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ টাকা। কিন্তু গুজব রটানো হয় এই বেতন ৬০ টাকা করা হচ্ছে। ফলে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে পরে। তাই ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেশনে ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে একটি সংকট তৈরি হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও উপাচার্য ড. হার্টগ দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন। তাঁর কার্যকালের পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শক্ত অবস্থানে এসে দাঁড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পরবর্তী কয়েকজন উপাচার্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এঁরা হচ্ছেন অধ্যাপক হ্যারি ল্যাংলি, এ. এফ. রহমান, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড. মাহমুদ হাসান।
ভারত বিভাগের পর বৃহত্তর আঙ্গিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটে। আবাসিক বিশ্বদ্যিালয়ের ধারাটি শিথিল করা হয়। এ পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কলেজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫টি।