ঢাকার কথা ১৪
কয়েকটি ক্ষুদ্র পেশা
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে নানা জরুরি এবং কম জরুরি জিনিসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ঢাকায় ফেরি করে নানা নিত্যপণ্যের জিনিস বিক্রি করার সাধারণ প্রচলন ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল হজমি বিক্রি। পেশাজীবী হজমিওয়ালাদের এখন আর চোখে পড়ে না।
ছোটদের মধ্যে টক স্বাদের এই হজমি খাওয়ার আগ্রহ বেশি ছিল। এ কারণে হজমিওয়ালাদের বেশি দেখা যেত স্কুলের গেটে। কালো দানাদার হজমি গুঁড়া একটি কাচের শিশিতে ভরা থাকত। ক্রেতাকে দেওয়ার আগে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করতে হতো। এই প্রস্তুত প্রক্রিয়া ছোটদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল। হজমিওয়ালার ঝুলিতে বা কাঁধে ঝোলানো ঝুড়িতে আরেকটি কাচের শিশি থাকত। তার মধ্যে থাকত পানির মতো দেখতে এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য। প্রথমে ক্রেতার চাহিদামতো ছোট কাগজের টুকরায় এক পয়সা বা দুই পয়সার হজমি রাখা হতো। তার মধ্যে তরল দ্রব্যটি এক-দুই ফোঁটা ফেলা হতো। সঙ্গে সঙ্গে একমুহূর্তের জন্য ধপ করে আগুন জ্বলে উঠত। এভাবে প্রস্তুত হতো হজমি। হজমি বিক্রি করেই এই দরিদ্র পেশাজীবীরা তাঁদের সংসার চালাতেন।
আরেক শ্রেণির পেশাজীবী শিংয়ের তৈরি চিরুনি আর বোতাম তৈরি করত। কাঁচামাল হিসেবে তাদের প্রথমে গরু ও মহিষের শিং জোগাড় করতে হতো। এ কারণে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে, কসাইয়ের দোকান বা ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করত পশুর শিং। তারা এগুলো বিক্রি করত চিরুনি তৈরির কারখানায়। শিং দিয়ে চিরুনি, বোতাম ইত্যাদি তৈরির কারিগরদের সাধারণ পরিচয় ছিল ‘খুন্দিগর’ নামে। এই অদ্ভুত নামটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘কুন্দিকার’ থেকে। মোগল শাসন পর্বে ঢাকায় ব্যবসা ও চাকরির আশায় অনেক ইরানি এসে বসবাস শুরু করে। তাদের মাধ্যমে অনেক ফারসি শব্দও প্রবেশ করে ঢাকাইয়া ভাষায়। গত শতকের চল্লিশের দশকেও ঢাকার নবাবগঞ্জে খুন্দিগরদের কয়েকটি কারখানা ছিল।
সমসাময়িক সূত্রে এসব কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমে শিংগুলো আগুনের উত্তাপে নরম করা হতো। তার পর কাঠ বা লোহার চাপে তাকে করা হতো সোজা ও চ্যাপ্টা। এক ধরনের ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রয়োজনমতো কেটে চিরুনি ও বোতাম বানানো হতো। এসব চিরুনি বোতাম বিক্রি হতো কলুটোলার হাটে।
বিশ শতকের আগে কাপড় ধোয়ার জন্য ঢাকায় বিদেশি সাবান সহজলভ্য ছিল না। এই অভাব পূরণে স্থানীয়ভাবে এক ধরনের সাবান তৈরি হতো। ছোট আকারের ফুটবলের মতো গোলাকৃতির হতো এই সাবানগুলো। সাধারণের কাছে এই কাপড় ধোয়ার সাবান ‘বাংলা সাবান’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকাইয়া ভাষায় সাবানকে বলা হতো ‘সাবুন’। এ কারণে জনপ্রিয় এই সাবানকে ঢাকার মানুষ বলত ‘বাংলা সাবুন’, পরে ‘বাংলা সাবান’ নামটি দেশজুড়ে প্রচলিত হয়ে যায়। ঢাকায় এই সাবান বিক্রেতারা পরিচিত ছিল ‘সাবুনওয়ালা’ নামে। কোনো কোনো সূত্র দাবি করে, ঢাকার বাংলা সাবান ভারত ও আশপাশের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হতো।
প্রথম দিকে বাংলা সাবানের কারখানাগুলো গড়ে ওঠে চকবাজারের কাছে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হবে, ছোট কাটরার আশপাশে। সাবানের কারখানায় অনেক শ্রমিক নিয়োগ করতে হতো। একদল শ্রমিক বড় কড়াইয়ে সাবানের উপকরণ জ্বাল দিত। এর পর আরেক দল শ্রমিক মণ্ড তৈরি করত। কেউ পিটিয়ে গোলাকার রূপ দিত।
সাবান তৈরির একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে একটি বড় পাত্রে সোডা, ক্ষার ও চুন পানির সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দেওয়া হতো। এর পর এগুলো কয়েক দিন ঠান্ডা অবস্থায় রেখে দেওয়া হতো। পরে যত্ন করে ফেলে দেওয়া হতো তলানির ময়লা। তার পর পশুর চর্বি অথবা তিলের তেল মিশিয়ে আবার জ্বাল দেওয়া হতো। সাবানের মান নির্ভর করত কত বেশি জ্বাল দেওয়া হয়েছে তার ওপর। ভালো মানের সাবান তৈরির জন্য ১৪/১৫ দিন সময় লেগে যেত।
খুচরা দোকানিরা বাংলা সাবান সের দরে বিক্রি করত। একেকটি সাবানের গোলা এক সের-সোয়া সের পর্যন্ত হতো। যাদের অল্প প্রয়োজন, ঝুলিয়ে রাখা তার দিয়ে কেটে টুকরো করে তাদের কাছে বিক্রি করা হতো। এখনো বাংলা সাবান একেবারে হারিয়ে যায়নি।
বর্তমানে দালানকোঠা নির্মাণ উপকরণে অনেক আধুনিক জিনিসপত্র যুক্ত হয়েছে। নির্মাণ-রীতিতেও এসেছে পরিবর্তন। তবে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত নির্মাণ উপকরণের দিক থেকে বড় রকমের পরিবর্তন হয়নি। শুধু ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় রীতি প্রবেশ করতে গিয়ে লোহার গ্রিল, ছাদের নিচে বিম এবং বিশেষ ধরনের মোজাইক ও টাইলসের ব্যবহার যুক্ত হয়েছে। আরসিসি, অর্থাৎ রড, কংক্রিট ও সিমেন্টের ব্যবহারের মতো আধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার তখনো শুরু হয়নি। বরাবর বালু-সিমেন্টের বিকল্প ছিল চুন-সুরকি। চুন-সুরকির গাঁথুনিতে ইট বসিয়ে দেয়াল তৈরি সহজ হলেও ছাদ নির্মাণ সহজ ছিল না। ছাদের চুন-সুরকির আস্তরণ জমাট বাঁধাতে, বিশেষ করে ছাদ শক্ত করতে ও বৃষ্টির পানি শোষণ রোধ করার জন্য নির্মাণের সময় ছাদ পেটাতে হতো। কোনো নির্মীয়মাণ ইমারতে ছাদ পেটানোর ছন্দে ছন্দে ধুপ ধুপ শব্দ ঢাকাবাসীর বেশ পরিচিত ছিল।
ছাদ পেটাতে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। ইংরেজ শাসন যুগে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার আর ব্যবসায়ীদের হাতেগোনা পাকা দালান ছাড়া বেশিরভাগ দালান তৈরি হতো ঢাকায়। তাই ঢাকায় ছাদ পেটানোর একটি পেশাজীবী শ্রেণি গড়ে ওঠে। ছাদে চুন-সুরকির ঢালাই দেওয়ার পর ছাদ পেটানো শ্রমিক দল এক ধরনের মুগুর দিয়ে তালে তালে ছাদ পেটাতে থাকত। সাধারণত কিশোর বয়সের ছেলেদের ছাদ পেটানোর কাজে নিয়োগ করা হতো। একজন ‘সর্দারে’র তত্ত্বাবধানে এই শ্রমিক দল কাজ করত। সাধারণত সর্দার এক হাতে ছাতা নিয়ে রোদ থেকে মাথা বাঁচাতেন আর অন্য হাতে একটি লম্বা বেত রাখতেন। কিশোররা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয়, তাই হাতে এই বেত রাখা। মাঝেমধ্যে হাওয়ায় বেত নাড়িয়ে শপাং শপাং শব্দ তুলতেন। তাতেই ভয় পেয়ে যেত কিশোর শ্রমিকরা। কাজে উৎসাহ দেওয়া বা গতি আনার জন্য একজন গায়ক রাখা হতো। তিনি বেহালা বাজিয়ে গানের একটি কলি টান দিতেন। শ্রমিকরা দোহারের মতো পরের লাইনে সুর তুলে তালে তালে ছাদ পেটাত। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এসব ছাদ পেটানো শ্রমিক নিয়োগ করা হতো।
১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর আগে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা ছিল একমাত্র আধুনিক বিনোদন। তা ছাড়া যাত্রা থিয়েটারের ধারা তো ছিলই। কিন্তু এসব বিনোদন মাধ্যম ঢাকার সাধারণ পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের কাছে সহজলভ্য ছিল না। বিনোদনের এই শূন্যতা পূরণে এক ধরনের পেশাজীবী ভূমিকা রাখেন। তাঁরা ছোটদের কাছে বায়োস্কোপওয়ালা নামে পরিচিত ছিলেন। বায়োস্কোপওয়ালারা একটি তিন কোনাকার কাঠের বাক্স এবং বাক্স বসানোর জন্য একটি স্ট্যান্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ছোটদের আকৃষ্ট করতে তাঁদের অনেকের পরনে থাকত সঙদের মতো রঙিন কাপড়ের তালি দেওয়া পোশাক। পায়ে পরতেন ঝুমুর। এক হাতে থাকত ঝুনঝুনি। বায়োস্কোপওয়ালারা সাধারণত স্কুলের কাছে বা জনবহুল এলাকায় রাস্তার ধারে বাক্স স্ট্যান্ডে বসিয়ে ঝুনঝুনি বাজিয়ে ছোটদের আকৃষ্ট করতেন। কখনো কোনো বাড়ি থেকে ডাক এলে বাড়ির ভেতরে উঠোনে বায়োস্কোপের আসর বসত। বাক্সের তিন দিকে মুড়ির টিনের মুখের মতো ফোকর থাকত। সেখানে বসানো থাকত আতশ কাচ। দুই পয়সা এক আনার বিনিময়ে বায়োস্কোপ দেখা যেত। দর্শক একেকজন একেক ফোকরে চোখ রেখে দাঁড়াত। শুধু ছোটরা নয়, অনেক সময় বয়স্করাও বায়োস্কোপের দর্শক ছিলেন। বাক্সের ভেতরে বিপরীত দিকে একটি দণ্ডে ধারাবাহিকভাবে অনেক রঙিন ছবি বসানো কাগজ রোল করা থাকত। ছবি বসানো কাগজের একটি দিক অন্য প্রান্তের দণ্ডে লাগানো হতো। এক প্রান্তের দণ্ড ঘোরালে ছবিগুলো ধারাবাহিকভাবে চলে আসতে থাকত। আতশ কাচের কারণে ছবিগুলো বড় আকারে দেখা যেত। এগুলোর মধ্যে থাকত তাজমহল, কুতুব মিনার, ষাটগম্বুজ মসজিদ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা, কবি—এসব ছবি। বায়োস্কোপওয়ালার ছবি দেখানোর অদ্ভুত ভঙ্গি ছিল। তাঁরা ঝুমুরের শব্দ তুলে ঝুনঝুনি বাজিয়ে সুরে সুরে ছবিগুলোর বর্ণনা দিতে থাকতেন। ছোটদের কাছে বায়োস্কোপ সে যুগে জনপ্রিয় বিনোদন ছিল।