চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ শেষ হবে কবে
অর্থনৈতিক রাজধানী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বৃষ্টিবিহীন দিনেও গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামে এক প্রকার স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা টানা বৃষ্টি হলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় প্রায় নগরজুড়ে। এতে নগরীর সড়ক, দোকানপাট ও বাসাবাড়ি হাঁটু থেকে কোমরপানিতে তলিয়ে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীদের। এই জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষও মারা গেছে নালায় পড়ে। চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বেশ কিছু মেগা প্রকল্প চলছে, তার মধ্যে জলাবদ্ধতা প্রকল্পটি অন্যতম। এ সব প্রকল্প নাকি বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতা আর থাকবে না। কিন্তু বছরের পর বছর গেলেও নগরের জলাবদ্ধতা যায় না। প্রকল্পও শেষ হয় না। বরং চলমান প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আর পাঁচ বছর পর পর জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে মেয়র প্রার্থীরা ভোট চান। একই সাথে সিডিএ নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে আসে।
একসময় চাকতাই-খাতুনগঞ্জে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের দুঃখ শিরোনামে নিউজ প্রকাশিত হতো প্রায় সব টিভি চ্যানেল আর দৈনিক কাগজগুলোতে। দুঃখ এখন আর চাকতাই-খাতুন গঞ্জকেন্দ্রিক নয়, পুরো নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা। চট্টগ্রাম শহরের বিশাল বিশাল জলাধার ভরাট করে আবাসিক এলাকা করা হয়েছে। পাহাড় কেটে সড়ক বানানো হয়েছে। শহরে নালার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় আর অপরিকল্পিত মার্কেট তৈরি করা হয়েছে। খালগুলো দখল করে সরকারি অফিস বানানো হয়েছে। সবই করা হয়েছে নগর ভবন থেকে। কিন্তু টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতা হলে তাঁরা নিরীহ জনগণের ওপর আঙুল তুলে বলতেন, ওরা চিপসের প্যাকেট আর পলিথিন ও ময়লা ফেলে এ অবস্থা করেছে।
এই যেমন চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার প্রতিশ্রুতিটা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু, কিন্তু দেশের অন্য কোথাও তেমনটা নেই। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জলাবদ্ধতা ইস্যুটিকে সামনে এনে তাঁদের নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জন্য একদল তারকা ক্যাম্পেইন করতে গিয়ে চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটকে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এখন যখন বৃষ্টিতে কোমর পরিমাণ পানি, তখন এসব তারকার তখনকার বক্তব্য নিয়ে ট্রল হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমল থেকে সর্বশেষ মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি ইস্যু হিসেবে আছে। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৭ বছর, বিএনপি থেকে নির্বাচিত এম মনজুর আলম পাঁচ বছর। আবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের ২৭ বছরে খাতুনগঞ্জ-চাকতাই খাল খনন, খালের তলা পাকাকরণ প্রকল্প থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত নানা প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পকেট ভরেছে। কিন্তু এর সুফল পায়নি নগরবাসী।
এদিকে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সিডিএ ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে জলাবদ্ধতা নিরসনে তাদের বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর পরও কাজ শেষ না হওয়ায় এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২১ সাল, এখন আবার ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হয় প্রকল্পের মেয়াদ। বলা যায় না এর মধ্যে প্রকল্প ব্যয় আরও কত বাড়বে।
চট্টগ্রামের ব্যাংক ও বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত আগ্রাবাদে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, জোয়ারের পানিতে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের অভ্যন্তরে নিয়মিতই পানি ঢুকছে হাঁটু পরিমাণ। চিকিৎসা সেবা নেবে কি মানুষ, নিজেই নর্দমার পানির সংস্পর্শে এসে সেখানে অসুস্থ হচ্ছে। এই দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন।
অথচ চট্টগ্রাম হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি, প্রাচ্যের রানি, বীর প্রসবিনী, আধ্যাত্মিক রাজধানী, বন্দরনগরী, আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরী, কল্যাণময় নগরী, এমন অসংখ্য নামে পরিচিত কী অসাধারণ একটি শহর চট্টগ্রাম। একইসাথে পাহাড়-সমতল-নদী-সমুদ্র মিলে একাকার। পৃথিবীতে এমন সমন্বয়ের শহর খুবই কম আছে।
অথচ চট্টগ্রামের সঙ্গে জলাবদ্ধতার সম্পর্ক এমন হয়েছে যে বর্ষা এলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পানি কবে নামবে সে প্রহর গুনতে হয় নগরবাসীদের। একদিকে জোয়ারের পানি, অন্যদিকে বৃষ্টির পানি; দুটি মিলে নগরজীবনে নাভিশ্বাস।
বন্দরনগরী বাকলিয়া বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর, জিইসি মোড়, বাদুরতলা, চকবাজার, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, গোসাইলডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় একটু বৃষ্টিতে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি ওঠে। দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাকতাই এলাকার ব্যবসায়ীদের জন্য বর্ষা মৌসুম এক অভিশাপের নাম। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাকলিয়া, চকবাজার, বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দারা বর্ষায় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই মৌসুম পার করে থাকে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় অনেক স্থানে নালা সংস্কারের কাজ চলছে। নির্মাণকাজের কারণে নালায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন স্থানে সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। একই সাথে অতি বৃষ্টির কারণে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কাও দেখা দেয়।
সিডিএ-র এক কর্মকর্তা বলেছেন, মেগা প্রকল্পের মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পটির জন্য মাত্র ১৭০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। যত দিন পর্যন্ত স্লুইসগেট নির্মাণ ও মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না, তত দিন জলাবদ্ধতা থাকবেই। বৃষ্টি মৌসুমে, বিশেষ করে মে থেকে জুলাই খালে কাজ না করে অন্যত্র কাজ করলে খালের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে পানি চলাচলের ব্যবস্থা হতো। কিন্তু ভরা মৌসুমেও রেগুলেটর তৈরির কাজ শেষ না হওয়ায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে, আবার বৃষ্টির পানি সরতে পারছে না।
সিডিএ-র কথা কতটুকু ঠিক হয় আর চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা দূর হতে নগরবাসীকে আরও কত বছর অপেক্ষা করতে হয়, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক : স্টাফ ক্যামেরাপারসন, এনটিভি, চট্টগ্রাম অফিস