জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন : জানা-অজানা
সেদিন ছিল ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০। বাংলাদেশের স্থপতি ও আওয়ামী লীগ প্রধান অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের তৎকালীন জেনারেল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠকে বসেন। সাধারণ নির্বাচনোত্তর সরকার গঠন নিয়ে টানটান রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে চলে রুদ্ধদ্বার সেই বৈঠক। ঠিক সেদিনই অকুস্থল থেকে বিশ মাইল দূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে সাভারের প্রায় সাড়ে সাতশ একর জায়গাজুড়ে।
মঙ্গলবার অপরাহ্ণ। ১২ জানুয়ারি ১৯৭১, ২৭ পৌষ ১৩৭৭, ১৪ জিলক্বদ ১৩৯০। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও চ্যান্সেলর হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের’ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। প্রখ্যাত রসায়নবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ ব্যয় বহন করা। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো থাকা সত্ত্বেও সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণাধীন রয়েছে।’
এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন জোর দিয়ে বলেন, ‘শুধুমাত্র এই বিশ্ববিদ্যালয় যে সংখ্যার প্রয়োজন মেটাবে তা নয়, এর মুখ্য উদ্দেশ্য শিক্ষার মানকে নীচে নামতে না দিয়ে বরং উন্নত করা। সত্যি আমাদের দেশের শিক্ষার মান যে দিনের পর দিন অবনতি ঘটছে তা নিতান্ত দুঃখজনক। সেই মানোন্নয়নের একটি প্রচেষ্টারই মহাপরিকল্পনা এ বিশ্ববিদ্যালয়।’
বক্তব্যে অ্যাডমিরাল আহসান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপ কমাতে নয় বরং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। টেকনিক্যাল ট্রেনিং ফ্যাক্টরি থেকে টেকনিশিয়ান তৈরির বদলে আদর্শ, মূল্যবোধ, জাতীয় গর্ব ও ঐতিহ্য বিস্তারের চারণভূমি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হবে।’
২০ আগাস্ট ১৯৭০ ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭০’ জারি করা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালের প্রারম্ভিকায় প্রাদেশিক সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, অতঃপর জুন ১৯৬৫ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় তা অনুমোদিত হয়। জয়দেবপুরের সালনায় স্থান নির্বাচন ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান কর্তৃক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও আশপাশের ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও তার দূষণ থেকে নির্মিতব্য উচ্চ শিক্ষাঙ্গনটি রক্ষা করার স্বার্থে স্থান পরিবর্তন করে সাভার উপজেলার প্রায় ৭৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। স্মর্তব্য যে, সমান্তরালভাবে ১৯৬৭ সালের ২২ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় আড়াই গুণ আয়তন (১৭০৯ একর) ও প্রায় তিন গুণ বাজেট বরাদ্দ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে পশ্চিম পাকিস্তানে ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় (পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে কায়েদ-ই-আযম বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করা হয়)-এর কার্যক্রম শুরু করা হয়।
প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে ১৯৬৭ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যান প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি তরঙ্গায়িত রক্তিম ভূ-দৃশ্য ও জলাভূমির সাথে সঙ্গতি রেখে লাল ইটের পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি করেন। যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য ১৭টি হলসহ ক্যাম্পাসের নান্দনিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একাডেমিক, প্রশাসনিক, আবাসিক ভবন ইত্যাদি সম্বলিত চার সেক্টরে বিভক্ত নকশা তৈরি করেন। ১৯৮০ সালের মধ্যে পুরোপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রায় ৩০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ে ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।
হতাশাব্যঞ্জক হলেও সত্য উদ্বোধনের দিন পর্যন্ত মাত্র একভাগেরও কম নির্মাণ অগ্রগতি সাধিত হয়। অর্থ বরাদ্দ ছিল খুবই অপ্রতুল। মাত্র ৭২ লক্ষ টাকা (১৯৬৫-১৯৭১) উদ্বোধনের মাত্র দুমাসের মধ্যেই দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া থমকে যায়। ভর্তিকৃত ছাত্রদের অনেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি শরীরচর্চা ও দেশে ক্রীড়ার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সুপরিসর স্টেডিয়াম নির্মাণ মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। এই বরাদ্দকৃত ক্রীড়া কমপ্লেক্সের স্থানেই বর্তমানে বিপিএটিসি অবস্থিত। ছাত্র-শিক্ষকদের সম্মিলিত ব্যাপক আন্দোলন ও বিপুল বিরোধিতা উপেক্ষা করে নজিরবিহীনভাবে ২৮ এপ্রিল ১৯৮৪ এক অধ্যাদেশ জারিপূর্বক ৫০ একরাধিক ভূমি জাহাঙ্গীরনগর থেকে তৎকালীন সামরিক জান্তা অধিগ্রহণ করে।
প্রতিষ্ঠাকালীন পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে ১৬টি বিজ্ঞানভিত্তিকসহ ২৭টি বিষয়ে পাঠদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৫টি অনুষদের মাধ্যমে বিভাগগুলো পরিচালিত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত অনুষদের নাম ছিল যথাক্রমে ক) কলা ও মানবিক, খ) সামাজিক বিজ্ঞান, গ) মৌলিক বিজ্ঞান, ঘ) জৈবিক বিজ্ঞান ও ঙ) ফলিত বিজ্ঞান। প্রয়োজন অনুযায়ী এর সংখ্যা যুগোপযোগী করে জাতির জরুরি চাহিদা মেটানোর মূলনীতি গ্রহণ করা হয়। চার হাজার দুই শত শিক্ষার্থীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সম্পূর্ণ শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ ও উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। উদ্বোধনের সময় ভূগোল, অর্থনীতি, পরিসংখ্যান ও গণিত এই ৪টি বিভাগ ছিল। সে সময় ১৫০ জন ছাত্র ভর্তি ও ২৬ জন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। প্রথম ব্যাচে কোনো ছাত্রী ভর্তি হয়নি কারণ আবাসিক সুবিধাদি ছিল না।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের শুরুতে ঠিক দুমাস আগে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ লোকের অকালমৃত্যুর স্মরণে গভীর শোক প্রকাশ করা হয় এবং সব ধরনের উদ্বোধন সাজসজ্জা ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান পরিহার করা হয়। ফলে ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশ ছিল বেশ সাদামাটা। বর্তমান বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং উপাচার্যের প্রথম অফিস ও প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগসমূহ মূলত এই ভবনেই সীমিত ছিল।
লেখক : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়