বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বপ্নের কারিগর
বঙ্গবন্ধু মহাকালের মহাকাব্যে হাজার বছরের শোষিত, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের এক দুঃসাহসিক কারিগর। তারুণ্যের এক আলোকযাত্রা। বঙ্গবন্ধু মানে বাঙালির আনন্দ-বেদনার মিলন, বিরহ আবেগের ক্যানভাস। বঙ্গবন্ধু মানে জলপাই রঙের ভিনদেশি সাঁজোয়া যানের বিধ্বংসী ব্যারিকেডের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার সীমাহীন অনুপ্রেরণা।
ছাত্রজীবন থেকেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক আবহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন। মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ও মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথ রোধ করে নজর কাড়েন। ওই বছর জাতির জনক প্রথম কারাবরণ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও শিল্প-সাহিত্যেও পারদর্শী ছিলেন পিতা মুজিব। পারিবারিক আবহ এবং গৃহশিক্ষক কিশোর মুজিবের রাজনৈতিক মনোভাবে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকাকালে মুজিব পুরোপুরি ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বে চলে আসেন।
তৎকালীন মুসলীম লীগ নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। ছাত্ররাজনীতি করলেও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিব সব সময় তৎপর ছিলেন। তাঁর এই মনোভাব একজন ভবিষ্যৎ জনপ্রতিনিধির আগমনী বার্তা দিয়েছিল। ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এসে তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দেশ বিভাগের পর পরই ভাষার প্রশ্নে উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলা। ’৪৮-এ, জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্রসমাজ। শেখ মুজিবসহ নেতৃস্থানীয়দের আটক করে সরকার। ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয় কারাবন্দিদের ছেড়ে দিতে।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে মুজিব পুনরায় আটক হন। ‘রাজনীতি করবেন না’—এই মর্মে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে মুক্তির প্রস্তাব দিলে মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল করে। মুজিবের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অন্যদের কাছে হার না মানার এক সাহসচিত্র ফুটে ওঠে। মুসলিম ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাচারিতা ও পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলায় মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর সুদূরপ্রসারী মনোভাব ছিল, যার প্রতিফলন ’৫২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭০, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষণীয়।
বাঙালির ভাগ্যাকাশে শেখ মুজিব এক ধ্রুবতারা। পলাশীর প্রান্তরে বাঙালির স্বাধিকারের অস্তমিত সূর্যোদয়ের দুঃসাহসিক অভিযাত্রী শেখ মুজিব। বাঙালির হাজার বছরের শাসন-শোষণের দীর্ঘ পরিক্রমায় স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বপ্ন দেখানোর মতো সূর্যসন্তানের আবির্ভাব ঘটেনি। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে বাঙালির সব স্রোতধারা অবশেষে মিলিত হয় মুজিব-মোহনায়। স্বজাতির প্রতি দায়িত্ববোধ আর সীমাহীন ত্যাগ মুজিবকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। বাঙালির আবেগ আর ভালোবাসা সবটুকু উজাড় করে মুজিবকে দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধু উপাধি।
কবিগুরুর সেই চিরায়ত বাণী, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’-কে মিথ্যে প্রমাণিত করে বাংলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া একটি দেশকে টেনে তুলতে দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খেলাধূলা, অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ প্রতিটি সেক্টরকেই তিনি যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সামনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথম বাঙালি হিসেবে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বকে অবাক করে দেন। বাংলা ভাষার মর্যাদাকে বহু গুণ বাড়িয়ে তোলেন তিনি।
বাঙালির স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে যখন দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে লাল-সবুজের একটি ভূখণ্ড, ঠিক তখনই এ দেশে আত্মগোপনে থাকা বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে সপরিবারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বকে থমকে দিয়ে চরম ঘৃণিত একটি অধ্যায়ের জন্ম দিল বাঙালি। যে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন, সেই বাঙালিই তাঁকে চরম ঘৃণিত একটি অধ্যায়ের মুখোমুখি করল। বাঙালির হাজার বছরের পরম আরাধনার ফসল আবারও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ধারাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শকে চিরদিনের জন্য মুছে দিয়ে পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠে ডালিম, খন্দকার মোশতাকেরা।
বঙ্গবন্ধু হয়তো আর কোনও দিন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। প্রিয় স্বদেশের শান্ত জলে গা ভিজিয়ে পথে-প্রান্তরে বটছায়ায় শরীর জুড়াবেন না। বর্ষার বিমোহিত লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজবেন না। নজরুলের অমর সৃষ্টির মাঝে হয়তো আর দ্রোহের আমীয় বাণী খুঁজবেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ এবং স্বপ্নকে বিলীন করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু অবিনশ্বর, চিরভাস্বর। কোটি তরুণের অনুপ্রেরণা আর আদর্শের বাতিঘর।
১৫ আগস্ট বিদেশে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুতনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন এবং তাঁর আদর্শকে চর্চার জন্যই সৃষ্টিকর্তা হয়তো দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা হতে খানিকটা পিছিয়ে। কিন্তু জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে দেশরত্নের নেতৃত্বে অটল অবিচল। একজন মুজিব আদর্শের তরুণ—আমি বিশ্বাস করি এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, স্বদেশের উন্নয়নে নিজেকে বিসর্জন দিতে পিছপা হব না। আমার মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা বেগবান করব। তারুণ্যের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব হয়ে উঠুক লাল-সবুজের ক্যানভাসে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ