১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও কিছু কথা
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫; যেদিন আমরা হারিয়েছিলাম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে। এটি নিছক কোনো এসেসিনেশন ছিল না, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই এই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল না। এটি ছিল মূলত একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসরদের সুগভীর চক্রান্তে সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যার আলটিমেট টার্গেট ছিল এই দেশ থেকে চিরতরে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস—সব মুছে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পরিচালিত করা, একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে একাত্তরের পরাজয়ের চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করা। আর তাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রত্যুষেই কুলাঙ্গার খুনি মেজর ডালিম সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছিল ‘ইসলামী রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ বলে। তার পর একে একে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা পবিত্র সংবিধানের চার মূল স্তম্ভ থেকে মুছে দেওয়া হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
মুজিবের দেশে নিষিদ্ধ হয় পিতা মুজিবের নাম। খুনিদের শুধু ইনডেমনিটি নয়, তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুরস্কৃত করে পদায়ন করা বিভিন্ন দূতাবাসে, যা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে একটি খুনি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এই নষ্ট ধারাবাহিকতা আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে লাগাতার ২১ বছর। এই নষ্ট সময়ে প্রতিহিংসা আর অমানবিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ আগস্ট নাজাত দিবস পালনের মতো জঘন্য, হীন, ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ১৯৮১ সালে দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত, দুঃসহ জীবন শেষে আওয়ামী লীগের সভাপতির গুরুদায়িত্ব নিয়ে স্বদেশভূমে ফেরেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনও তাঁকে বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের তীর্থভূমি ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। অবশেষে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের রক্তাক্ত পিচ্ছিল, বন্ধুর গিরিপথ অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী, কালজয়ী নেতৃত্বে সেই অমানিশার ঘোর কাটিয়ে আমরা আলোর দেখা পেলাম। বাতিল হলো কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন। বিচারের আওতায় আনা হলো খুনিদের। বাঙালি মুক্তি পেল পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে। শুরু হলো আমাদের নতুন আলোয় পথচলা। এই পথ পরিক্রমায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশনারি, ডায়নামিক নেতৃত্বের প্রশংসায় আজ গোটা বিশ্ব পঞ্চমুখ।
বঙ্গবন্ধুকে আমরা আর কখনো ফেরত পাব না। দুনিয়ার নিয়মে সেই সুযোগও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শরীরী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলেও আদর্শের মুজিবকে হত্যা করতে পেরেছে কি না? উত্তর, অবশ্যই নয়। আসলে মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল, মহানুভব ব্যক্তিত্বের জন্য সেটা আরো অসম্ভব। যাঁর সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রো, এডওয়ার্ড হিথ থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক মানের নেতৃবৃন্দ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা খুলে দেওয়ার কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সমালোচিত হয়েছিলেন। এই সমালোচনার জবাবে সেদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে হিথ বলেছিলেন, ‘আমি কোনো দেশের সরকার প্রধানের গাড়ির দরজা খুলে দিইনি বরং বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এক মহান নেতাকে গাড়ির দরজা খুলে ব্রিটিশদের সম্মানিত করেছি।’ এই হচ্ছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমরা তাঁরই আদর্শের অকুতোভয় সৈনিক। তাঁর এই আদর্শকে চির অম্লান রাখতে হলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তাঁরই দেখানো পথে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে মানুষের সাথে থাকতে হয়। কীভাবে সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘মধু মক্ষিকার লোভে যারা দলে ভিড়েছে তারা আমার দলের কেউ নয়, আওয়ামী লীগের ত্যাগীরা নেতা-কর্মীরা যেন তাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন, এই সুবিধাবাদী, ধান্ধাবাজ, ধাপ্পাবাজ রাজনীতি ব্যবসায়ীরা যদি দলের নেতৃত্বে আসে সেদিন আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হবে।’ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আজ আমাদের সময় এসেছে বঙ্গবন্ধুর এই অমীয় বাণী বাস্তবায়নে আজ সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের কথা শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার চর্চা করা অপরিহার্য। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনে, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে, মহান জাতীয় সংসদসহ সেই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণগুলোর মর্মার্থ যদি আমরা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করি এবং একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রত্যেকেই নিজেদের জীবনে কিছুটা হলেও প্রতিপালন করি, এই দেশ অচিরেই সোনার বাংলায় পরিণত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।
সেদিন আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘যেদিন এই দেশের মানুষ আর না খেয়ে মরবে না, তারা পরনের কাপড় পাবে, দুবেলা পেট ভরে খেতে পারবে সেদিন আমি মরেও শান্তি পাব।’
তাই এবারের জাতীয় শোক দিবসে আমাদের শপথ হোক কথামালার রাজনীতি নয়, স্লোগান-সর্বস্ব রাজনীতি নয়, বিত্ত-বৈভব লাভের রাজনীতি নয়, হালের রাজনীতির নামে সেলফিবাজির রাজনীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া নীতি-আদর্শের আলোকে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে আধুনিক, উন্নত বাংলাদেশের রূপকার, স্বাপ্নিক নেতৃত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার। জয় আমাদের হবেই ইনশা আল্লাহ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ