সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড
“Millions of fathers in rain
Millions of mothers in pain
Millions of brothers in woe
Millions of sisters nowhere to go”
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক কবিতার পংক্তিমালা এটি। মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচিত ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ থেকে উৎকলিত। কবিতাটির উপজীব্য আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহামতি এরিস্টটল তাঁর রচিত ‘পোয়েটিকস’ গ্রন্থে বলেছেন, ট্র্যাজেডি হলো একটি গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তন বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ, ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়; আর এই ক্রিয়া ভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্য দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলোর ক্যাথারসিস বা পরিশুদ্ধি ঘটায়। এই অর্থে অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতাটি ট্র্যাজিক অভিধায় অভিষিক্ত। যশোর রোডের মানবিক বিপর্যয়ের যে প্রতিচ্ছবি তিনি তাঁর কবিতায় অনুকরণ করে শ্রেষ্ঠতম ভাষার সৌন্দর্যে প্রকাশ করেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ-এ গান গেয়েছিলেন নোবেলজয়ী সংগীতকার বব ডিলান। তাঁর পাশে বসা ছিলেন মিউজিক কিংবদন্তি জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশঙ্কর। যে দেশটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী, সেই দেশের মানুষ আমাদের বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। ওই কনসার্টের মহামানবেরা অ্যালেন গিন্সবার্গের এই কবিতাটিকেও মহত্তম সঙ্গীতে রূপান্তর করেছিলেন, নোবেলজয়ী বব ডিলান ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য।
একটা নতুন জাতিরাষ্ট্রের জন্মবেদনা যে কতটা ভয়াল, ভীতিকর ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে, তার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী। সেখানকার শিশুরা পর্যাপ্ত বাসস্থান, খাবার ও ওষুধ পাচ্ছে না। তার ওপর প্রতিদিনই পাকিস্তানি মিলিটারি জায়ান্টদের বর্বরোচিত হামলায় মারা যাচ্ছে নির্বিরোধ মানুষ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের শেষ সময়ে এসেও বিপন্ন মানুষ যশোর রোড দিয়ে বাঁচার আশায় রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে। দানাপানিহীন উদর, শিশুদের কান্না, নারী ও বয়োবৃদ্ধদের আহাজারি, হাড়জিরজিরে কঙ্কালসার সেসব মানুষের দুর্ভোগ চোখে দেখা যায় না। মেনে নেওয়া যায় না।
ওই সময় মার্কিন মুল্লুক থেকে উড়ে এসেছিলেন মানবতার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। যিনি স্থানীয় পত্রিকায় বাংলাদেশের ভয়াল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবেন বলে এসেছিলেন। তিনি এলেন, দেখলেন এবং আর্দ্র হৃদয় নিয়ে যশোর রোডের কবিতা লিখলেন। বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিলেন। আর হয়ে রইলেন হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির আপনার জন। প্রিয় স্বজন।
কবি লিখলেন—
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর, ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে,/ যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ এত এত লোক শুধু কেন মরে?/ শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শিশু মরে গেল,/ যশোর রোডের যুদ্ধক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো/ কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে,/ আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে?/ ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ,/ মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালো রাত কবে হবে শেষ। লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে/ লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়/ ঘরহীন ভাসে শত শত লোক/ লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।/ রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু / পেটগুলো সব ফুলে-ফেঁপে ওঠে / এইটুকু শিশু এতবড় চোখ / দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে। / সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর/ এত শুধু মানুষের মুখ / যুদ্ধ-মৃত্যু তবুও স্বপ্ন / ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।
কবিতার এই চরণগুলো পাঠে আজও চোখের জলে কে না সিক্ত হয়। কার না স্মরণে আসে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভীষিকাময় সেই সব দিনের স্মৃতি। ঐতিহাসিক যশোর রোডের লাখো শরণার্থীর মানবেতর জীবনযাপন, ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না, ধর্ষিত মায়ের আহাজারি, গুলি খাওয়া সন্তানের মাতৃশোক।
যশোর রোড থেকে কলকাতার সেই সময়কার শরণার্থীর বিশাল মিছিল দেখে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান কবি। নিউইয়র্কে টানা তিন দিন বসে অ্যালেন গিন্সবার্গ লেখেন ঐতিহাসিক এই কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। পরবর্তী সময়ে কবিতাটি তিনি বিভিন্ন স্থানে পড়েও শোনান। বাংলাদেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে সবার কাছে সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দেন হাত।
বিশ্বমানুষের দৃষ্টি ফেরান বিপন্ন বাংলাদেশের দিকে। এত কেবল একটা কবিতা মাত্র নয়। মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য ডকুমেন্টারি।
১৫২ লাইনের দীর্ঘ কবিতাটি সে সময় দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত বিশ্বমানবতা বাংলার গণহত্যার নিন্দা ও ধিক্কার জানাতে থাকে।
লেখক আহমেদ রিয়াজ লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরে আবৃত্তি করেন ‘যশোর রোড’। অগণিত দর্শকের মধ্যে সেখানে বব ডিলানও উপস্থিত ছিলেন। কবিতাটি বব ডিলানকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, সে রাতেই গিন্সবার্গের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হলেন ডিলান এবং কবিতাটিকে গানে রূপ না দেওয়া পর্যন্ত যেন কিছুতেই থামতে পারছিলেন না। আর গিন্সবার্গও গানের লিরিকের কথা মাথায় রেখেই কবিতার শব্দমালা সাজিয়েছিলেন।
কালজয়ী এই কবিতাটির জন্যে সেপ্টেম্বর মাস আমাদের কাছে ধরা দেয় ভিন্নমাত্রায়। কবিতার শেষ লাইনগুলো অনবরত বেজে চলে মস্তিষ্কের নিউরণে।
যশোর রোডের যুদ্ধক্ষেত্রে
ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধ মরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে
১৯৬০ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া গিন্সবার্গ ১৯৮৬ সাল থেকে আমৃত্যু ব্রুকলিন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কাব্য পড়াতেন। শেষ জীবনে বৌদ্ধধর্মের অহিংস মতাদর্শে ঝুঁকে পড়েন।
সাহিত্যিক গিন্সবার্গের বই ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ ১৯৭৪ সালে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড এবং তিনি ১৯৭৯ সালে ‘ন্যাশনাল আর্টস ক্লাব’ থেকে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি রবার্ট ফ্রস্ট মেডেল পান ১৯৮৬ সালে। ১৯৯৫ সালে তাঁর বই ‘কসমোপলিটান গ্রিটিংস : পয়েমস ১৯৮৬-১৯৯২’ পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল।
বৃহত্তর যশোর বেল্ট কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল ও চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের স্মৃতিধন্য। অ্যালেন গিন্সবার্গও সেই স্মৃতিস্মারকে শ্রেষ্ঠতম সংযোজন।
১৯৯৩ সালে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অ্যালেন গিন্সবার্গ বলেছিলেন, ‘যা দেখলাম, অবর্ণনীয়। আমরা পশ্চিমারা দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধের কারণে সাধারণ মানুষের এমন মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক চিত্র আগে কখনো দেখিনি। আমি সাদা চামড়া, আমাকে দেখে শরণার্থীরা এগিয়ে এল সাহায্যের আশায়। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। ক্যামেরায় সেই সময়ের বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিলাম, যা পরে একটা নেগেটিভের বাক্সসহ হারিয়ে যায়।
শরণার্থীশিবিরে ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গেলাম। প্রতিদিনই ভাবতে থাকি, বাংলাদেশের জন্য আমি কী করতে পারি। হঠাৎ মাথায় এল, আমি কবিতা লিখতে তো পারি। লিখেও প্রতিবাদ করা যায়। কয়েক দিন ঘরে থেকে লিখলাম একটি দীর্ঘ কবিতা—সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। আমার বিক্সবি ক্যানিয়ন টু যশোর রোড নামের বইটিতে কবিতাটি ছাপা হয়েছে।’
আর এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে গাঁথা হয়ে গেল সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড। আর আলোকের ঝর্ণাধারা কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ আমাদের কাছে হয়ে রইলেন স্বাধীনতার ভিন্নতর বাতিঘর।
সেই অনন্য অসাধারণ বাতিঘরের জন্য রাখা থাক রাবীন্দ্রিক এই নৈবেদ্য—
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া
প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার
নুইয়ে দাও॥
লেখক : সাংবাদিক