‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল’
মাথা উঁচু করে সবুজের ছায়াঘেরা বিচিত্র অভিজ্ঞতা ধারণ করে সুপ্রাচীন বিশালাকার শতবর্ষী বৃক্ষ শ্যামলীমার আচ্ছাদনে আবৃত এখনও সেই সড়ক। ঐতিহাসিক সেই যশোর রোড যেন আজও কথা বলে। ফিরে দেখা স্মৃতির চিৎকারে ক্ষুধার্ত পেট অসহায় চোখ আজও যেন ছুটতে থাকে হৃদয়ভেজা নদী সাঁতরে। অর্ধশত বছর পেছনে ফিরে তাকালে সেখানে হেঁটে চলা মানুষের স্বপ্ন যেন আশার হরিণ হয়ে ওঠে, আকুতির অনুভূতি জড়িয়ে থাকা অসাড় দেহগুলোও আশ্রয়ভূমির উদ্দেশে হাঁটে হেলেদুলে।
মার্কিন কবি আরউইন অ্যালেন গিন্সবার্গ স্বচক্ষে দেখে উপলব্ধি করেছিলেন সেই চোখ, সেই মন; লিখেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। পরে যা বাংলায় অনুদিত হয়েছে এভাবে, ‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে/শত শত শত মানুষের দল/যশোর রোডের দু’ধারে বসত/বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল।’ এই কবিতার কথা থেকে পরে মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠের গান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
১৯৭১ সালে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে যশোর জেলা শহরের বকচর পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার, ভারত অংশে ৬১ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল এই পথ। বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার এই ছায়া শীতল মসৃণ রাস্তার শেষে অবস্থিত আমাদের বৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। বাংলাদেশ-ভারতের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিদিনই দুদেশের মধ্যে রক্তনালীর মতো সঞ্চালিত হয় এই রোডের মাধ্যমে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় এই রোড দিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে গিয়েছিল, যা ১৮৪০ তৈরি করেছিলেন বকচরের জমিদার কালিপ্রসাদ পোদ্দার তার মায়ের গঙ্গাস্নানের জন্য।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। জানা যায়, এ সময় তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিষয়টি দাগ কেটেছিল কবিমনে। অ্যালেন গিন্সবার্গ আরও কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলেন বুভুক্ষু যুদ্ধক্লান্ত মানুষদের। সে সময় ভারী বৃষ্টিতে ডুবে গিয়েছিল যশোর রোড। তাই সড়ক পথে না পেরে সুনীলকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছান কবি। আর প্রত্যক্ষ করেন শরণার্থীদের দুর্দশা। সেই অনুভূতি চিত্রিত করেন কবিতায়। পরে দীর্ঘ কবিতায় সুর দিয়ে গানে রূপ দেন। আমেরিকায় ফিরে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় বাংলাদেশি শরণার্থীদের অর্থ-সহযোগিতার জন্য আয়োজন করেন কনসার্টের।
অ্যালেন গিন্সবার্গের এই অবদান আজও বাংলার মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এভাবেই যশোর রোড ও সেখানকার বৃক্ষগুলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হয়ে ওঠে। এভাবেই ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড' আমাদের কাছে অমর কবিতা। যে কবিতায় ফুটে আছে বেঁচে থাকার প্রত্যাশায় জীবনবাজি রেখে ভারতের কলকাতায় পাড়ি জমানো মানুষের দুঃসহ বেদনার ইতিহাস। যশোর রোড আজও যেন স্মৃতি বুকে নিয়ে বয়ে বেড়ায়। স্মৃতি বয়ে বেড়ায় সেই রোডের বাতাস, যা আজও স্মৃতি জাগানিয়া দুই বাংলার সোনালি কাব্য। তাই আজও আমাদের মনের দৃষ্টি হেঁটে যায় সেই পথে।
এই সড়ক তৈরিরও একটি ইতিহাস আছে। মায়ের জন্য ভালোবাসার অম্লান উদাহরণ সেটি। জানা যায়, বকচরের জমিদার কালিপ্রসাদ পোদ্দার নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার জন্য জমিদারের মা গঙ্গা স্নানে না যেতে পারার কারণে অপমান বোধ করেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে আটকে নেন নিজেকে। উদ্বিগ্ন ছেলে তার মাকে অনশন ভাঙার অনুরোধ করলে মা শর্ত দেন—গঙ্গাস্নানের জন্য বকচর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন ভাঙবেন। কালিপ্রসাদ মায়ের দাবি মেনেই গঙ্গাস্নানের জন্য বকচর থেকে কলকাতার কালীঘাট পর্যন্ত নির্মাণ করেছিলেন।
ছায়ার জন্য ওই সড়কে দুই পাশে শিশুগাছ লাগানো হয়। সেই গাছ কালের সাক্ষী হয়ে ওঠে উত্তাল একাত্তরে। এই পথ ধরে স্বজনহারা, সম্ভ্রমহারা, স্বামী-সন্তান ঘরহারা লাখ লাখ শরণার্থীকে দিয়েছিল ছায়া।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক