৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির মহাকাব্য
৭ মার্চ, বাঙালি জাতির মুক্তির পথ, ঠিকানা খোঁজার স্মরণীয় একটি দিন । স্বজাতি ও স্বাধিকারবোধে উদ্দীপ্ত বাঙালির ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন ৭ মার্চ । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এইদিনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন আজও এর তাৎপর্য জাতীয় জীবনে গভীরভাবে অনুভূত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর দুই যুগব্যাপী সংগ্রাম-সাধনার মধ্য দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মুক্তির যে মোহনায় উপনীত হয়েছিল তাকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অবিস্মরণীয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিপাগল বাঙালির মনে প্রত্যয়ের যে বীজ বপন করেছিলেন বিশ্বের ইতিহাসেই এটি এক বিরল ঘটনা। এমন দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও নেই। এটি বাঙালির গর্ব ও অহংকারের।
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এখন বিশ্বঐতিহ্যের স্মারক। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণ ছিল অলিখিত। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লাখ লাখ জনতার সামনে তিনি ভাষণটি দিয়েছিলেন। কিন্তু উপস্থিত সকলের কাছে মনে হচ্ছিল যেন তিনি একটি লিখিত কবিতা পাঠ করেছেন। এই ভাষণের কারণেই বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। ভাষণটি জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। যে ভাষণ ছিল বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের এক গৌরবগাথা, সে ভাষণ এখন বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। বাঙালি জাতির জন্য এ এক বড় অর্জন।
বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির মহাকাব্য। এ মহাকাব্য বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এমন মহাকাব্য রচনা সম্ভব ছিল, কেননা তিনিই হলেন এ ধারার সার্থক প্রতিনিধি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে। পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয় জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ভাষণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এ ছিল একজন দক্ষ কুশলীর সুনিপুণ বক্তব্য উপস্থাপনা। বিশেষ করে ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না, অপরদিক তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও শাসকগোষ্ঠীর জন্য আদৌ সহজ ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যুজ্জ্বল দিকনির্দেশনা। এই ভাষণের প্রতিটি আহ্বান অধিকারবঞ্চিত দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তাই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীর সেই দিনটিতে আমরা আবারও নতুন করে শপথ নিই ‘এবারের সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, প্রায় ১৮ মিনিটের এই ভাষণে সবদিকই উঠে এসেছিল। ‘এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন।’ ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো।’ এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র ভাষণ যার মধ্য দিয়ে গোটা বাঙালি জাতি সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ-অবিশ্বাস ঝেড়ে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালি জাতির জন্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের শৃঙ্খল ছিন্ন করে জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনা। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই হচ্ছে বিশ্বসেরা ভাষণ। অনেকে এ ভাষণকে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৮৬৩ সালের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আব্রাহাম লিংকনের সে ভাষণও ছিল সংক্ষিপ্ত (মাত্র ৩ মিনিট) ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, পর্যালোচনা হয়েছে, বিশ্লেষণ হয়েছে, এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিন্তু এ ভাষণের পর তৎকালীন সময়ে বাঙালি জাতির ওপর কি প্রভাব পড়েছে বা মানুষ কিভাবে দ্রুত স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছে সেটি খুব আলোচনা হয়নি, যা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো জরুরি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা।