ক্রিকেট
বাংলাদেশের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়ার শাপমুক্তি
রেকর্ডময় এক টেস্ট, যার শেষটাও হলো রেকর্ডে। এবং যে রেকর্ডটা মনে রাখতে চাইবে না বাংলাদেশ। কারণ, এটা লজ্জার। হতাশার। এই রেকর্ড কারো পছন্দসই নয়। ১৪০ বছরের টেস্ট ইতিহাসে ৫৯৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে কেউ হারেনি। বেসিন রিজার্ভে বাংলাদেশ হারল। এই হার অনেক নাটকীয়। ম্যাচের শেষ দিন এত নাটকীয় পরিবর্তনের কথা ক্রিকেট জ্যোতিষীরাও বলতে পারেননি। এই না পারাই টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য, যেটা খুঁজে বেড়ান ক্রিকেটপ্রেমীরা। বেসিন রিজার্ভের দর্শকদের সেটা পেতে মানিব্যাগ থেকে ডলার গুনতে হয়নি। বিনা পয়সায় মাঠে ঢোকার ব্যবস্থা করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট-কর্তারা। টেস্ট ক্রিকেট মরে যাচ্ছে। ওটাকে বাঁচাতে হবে। এ রকম একটা আওয়াজ চারদিকে। সেই আওয়াজ তোলা চিন্তিত মানুষগুলোকে খানিকটা লজ্জায় ফেলে দিল নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ প্রথম টেস্টটা!
বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা যতটা লজ্জিত, যতটা হতাশ তার চেয়ে বেশি মর্মাহত। মর্মবেদনায় পুড়তে পুড়তে তাঁরা দেখলেন, এভাবেও টেস্ট হারা যায়! জয়ের খুব কাছে গিয়ে বাংলাদেশ এর আগেও হেরেছে। হতাশ হয়েছে। কিন্তু এই হার অনেক দিন পোড়াবে বাংলাদেশকে। কারণ, ওয়েলিংটন টেস্টেও পঞ্চম দিনে যা কিছু নাটকীয় তার জোগানদাতা যে বাংলাদেশ! কী ব্যাট করলেন তাঁরা দ্বিতীয় ইনিংসে! ১৬০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া বড় বিষয় নয়। বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তাঁদের ব্যাটিংয়ের ধরন! কী পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাট করছিলেন তাঁরা, কিছুই বোঝা গেল না। টেস্ট জয়ের কথা মাথায় রেখে, নাকি টেস্ট বাঁচানোর কথা মাথায় ছিল? উত্তরটা শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই জানেন। তবে স্ট্যান্ড ইন ক্যাপ্টেন ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, সেটাই আপাতত সত্য। বাজে শট। বাজে শট খেলেছেন ব্যাটসম্যানরা।
বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখে মনে হতেই পারে বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যাট করলেন তাঁরা। অনেক সময় নিজেদের ক্ষমতা বুঝতে না পেরে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায় মানুষ, যা হিতে বিপরীত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হলো। কথাটা মাথায় রেখেই লিখতে হচ্ছে, যাঁরা বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাঁরাই স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ডোবালেন। তারপরও তাঁদের ঘিরেই স্বপ্ন দেখবে বাংলাদেশ। ওয়েলিংটনে বাংলাদেশের সামনে জয়ের সূর্য উঁকি দিয়েছিল। আবার অস্ত গেল। এবং খুব তাড়াতাড়ি!
ক্রাইস্টচার্চে আবার নতুন সূর্য উঠবে। নতুন দিন শুরু হবে। নতুন সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ পরের টেস্ট শুরু করবে। পেছনে পড়ে থাকবে এই ইতিহাস, যেটা বাংলাদেশ লিখল ওয়েলিংটনে। তবে স্বর্ণাক্ষরে নয়। ওটা ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির হৃদয়ে খোদাই হয়ে থাকবে কষ্ট বাড়াতে। ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৬ জানুয়ারি দেখলে ইতিহাস-মনস্ক বাঙালি ক্রিকেটানুরাগীর মনে পড়ে যেতে পারে বেসিন রিজার্ভের কথা, যেখানে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের জাদুঘর। বেসিন রিজার্ভে বাংলাদেশ শুধু একটা টেস্ট হারল না, সেখানে জমা রেখে এলো কফিনবন্দি একটা জয়ের স্বপ্নকে। যে কফিনের ওপর বাঙালির দীর্ঘশ্বাস পড়তে পারে লম্বা সময় ধরে।
আগামীতে কোনো বাঙালি ক্রিকেট পর্যটক বেসিন রিজার্ভে গেলে তাঁর মনে পড়তে পারে বাংলাদেশের হার। বুকের ভেতর এক ধরনের হাহাকার অনুভব করতে পারেন। তবে যে জায়গায় বাঙালির হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস জমা পড়ল, সেখান থেকেই নিজেদের এখন লজ্জামুক্ত ভাবলেও ভাবতে পারে অস্ট্রেলিয়া। কারণ, ১২২ বছর ধরে লজ্জার এক রেকর্ড কাঁধে করে বয়ে বেড়াচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই ১৮৯৪ সালে সিডনিতে প্রথম ইনিংসে ৫৫৬ রান করেও হেরেছিল তারা। বাংলাদেশ যেন অস্ট্রেলিয়াকে সেই শাপমুক্তি দিল; নিজেরা নীলকণ্ঠ হয়ে। অবশ্য নিউজিল্যান্ড যাত্রায় বাংলাদেশ সেই সিডনিতেই কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছিল! নিউজিল্যান্ডে গিয়ে সেই সিডনির প্রতিও খানিকটা কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করল বাংলাদেশ! টেস্টে প্রথম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান করে হারের সঙ্গে সিডনির নামটা আর থাকছে না। ইতিহাসে খোদাই হয়ে গেল ওয়েলিংটনের নাম।
ওয়েলিংটন টেস্টে হার লজ্জার। হতাশার। চিন্তার। তবে তার পরও এই টেস্টে বাংলাদেশ নিজেদের ক্ষমতাটা নতুন করে আবিষ্কার করল। এটাই বা কম প্রাপ্তি কী!
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।