ক্রিকেট
পরাজিতকে মানুষ মনে রাখে না
নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের ব্যালান্সশিটের চেহারাটা কেমন দাঁড়াল? ক্রিকেটীয় গণিতজ্ঞদের চটজলদি উত্তর হতে পারে, প্রাপ্তি অনেক। ওয়েলিংটন টেস্টে প্রথম ইনিংসে লিড। সাকিবের ডাবল সেঞ্চুরি। মুশফিকের বড় সেঞ্চুরি। পঞ্চম উইকেটে রেকর্ড পার্টনারশিপ। ইনজুরি আক্রান্ত মুশফিকের জায়গায় গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে ইমরুল কায়েসের পাঁচটা ক্যাচ, যা টেস্ট ইতিহাসে বিশ্বরেকর্ড। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের আগে বাংলাদেশ দলে ইনজুরি হানা দিল। মুশফিকের পর মুমিনুল, ইমরুলও ছিটকে গেলেন। দলে ফিরলেন সৌম্য। শুধু দলে নয়, ফর্মেও ফিরলেন এই বাঁহাতি। টেস্ট ক্যাপ মাথায় ওঠা তাসকিন-সোহান-শান্তরা প্রমাণ করলেন, বড় মঞ্চে পারফর্ম করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত। আর সেটা প্রমাণ করার কাজটা খুব সহজ ছিল না।
নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে পারফর্ম করার কাজটা কখনোই সহজ না। বল বাউন্স করে। সিম করে। সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি। স্যাঁতসেঁতে ভাব। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে যতই হৈচৈ হোক, নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে পরিবর্তন হয়েছে, তা কেউ বলবেন না। ভারত-পাকিস্তান দ্বিমত প্রকাশ করার হাজারটা বিষয় খুঁজে পায়। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে ক্রিকেট খেলা কঠিন, সব ভেদাভেদ ভুলে এই একটি বিষয়ে তারাও সহমত। স্মৃতির সরণি দিয়ে হাঁটলে লয়েড-ভিভ-বোথাম-বয়কট-বোর্ডার-স্টিভ ওয়াহ তাঁরাও বলবেন, নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন, উইকেট সব সময় ক্রিকেটারদের কঠিন পরীক্ষা নেয়। পৃথিবীর অন্য কোথায় ক্রিকেটারদের এত পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। সেই জায়গায় বাংলাদেশের ছোট ছোট যা প্রাপ্তি, তার যোগফল অনেক বড়। তবে প্রাপ্তির খাতায় শুধু জয় বলে কিছু নাই।
শেষের এই ‘জয়’ আর ‘নাই’ শব্দ দুটো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গোটা নিউজিল্যান্ড সফরে একটা জয়ও নেই বাংলাদেশের। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে জয়ের সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে উঁকি দিয়েছিল। আবার ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল! ওয়েলিংটন ও ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে হার এড়ানোর সুযোগ এসেছিল। বৃষ্টিও খানিকটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সৌজন্যতার হাত ধরে ম্যাচ বাঁচাতে চায়নি বাংলাদেশ! অতি পজিটিভ ক্রিকেটতত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে খানিকটা বেহিসাবি হয়ে পড়ল বাংলাদেশ! টেস্টে জয়ের জন্য বাড়তি ঝুঁকি তখনই নেওয়া যায়, হার এড়ানো যখন নিশ্চিত। এসব কথা বাংলাদেশ ভুলে বসল। জিততে গিয়ে হারের চেয়ে হার এড়ানোর জন্য ড্র অনেক ভালো। অন্তত নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। সেটা বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট মানতে চাইল না! নিউজিল্যান্ডে নতুন ইতিহাস তাই লেখা হলো না; বরং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। সমৃদ্ধ হলো না বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিসংখ্যান।
ক্রিকেট অবশ্য পরিসংখ্যানের খেলা। আপনি খেললে পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ হবেই। নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ কোনো ম্যাচ জেতেনি। হারের সংখ্যাটা বেড়েছে। এই বাড়বাড়ন্তে বেশি নজর কাড়বে বাংলাদেশ দলে ইনজুরির তালিকাটা। একের পর এক ইনজুরিতে পড়েছেন ক্রিকেটাররা। পেশাদার জমানায় অনেক বেশি ক্রিকেট খেলতে হয় তাঁদের। লড়তে হয় ইনজুরির সঙ্গে। তাই বলে ২২ জনের দল নিয়ে সফরে গিয়ে দেখা যাবে অর্ধেক ক্রিকেটারই ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন! বাংলাদেশ দলের এ অবস্থা দেখে এক সাংবাদিক তো লিখে ফেললেন, নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুম তো মিনি হাসপাতালে পরিণত হয়েছে! দলে তো ফিজিও-ট্রেনার-ম্যাসাজের লোকও আছেন।
এ সফরে থাকল না শুধু বাংলাদেশের একটা জয়। তারপরও এই সফর সাকিব আল হাসান মনে রাখতে পারবেন তাঁর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কারণে। ডাবল সেঞ্চুরি। হাফ সেঞ্চুরি। উইকেট। সবই আছে তাঁর। সঙ্গে হাহাকারও থাকবে! কারণ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পারলে তিনিই পারতেন বাংলাদেশকে টেস্ট জেতাতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স কারো নেই। টেস্ট ক্যারিয়ারে তাঁর নিজের পারফরম্যান্সও সবচেয়ে ভালো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ব্ল্যাক ক্যাপদের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বেশি আটটা টেস্ট খেলেছেন তিনি। করেছেন ৭৬৩ রান। গড় ৬৩ দশমিক ৬৬। ক্যারিয়ারের চারটা সেঞ্চুরির দুটোই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। পরিসংখ্যান বলছে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলা তাঁর কাছে অনেক বেশি উপভোগ্য। সেটা দেশে কিংবা দেশের বাইরে। আক্ষেপটাও তাঁরই বেশি। অদৃষ্ট তাঁকে সুযোগ হয়তো দিয়েছে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টজয়ী দলের সদস্য এখনো হতে পারলেন না তিনি। ভেতরের দহন তাঁরই বেশি হওয়ার কথা। হয়তো হচ্ছে। কিন্তু সেই দহন না যায় দেখা। না যায় অনুভব করা!
বাংলাদেশ দল। সাকিব আল হাসান। সবার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েও একটা কথা লিখতে হচ্ছে, পরাজিতকে মানুষ মনে রাখে না।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।