রোহিঙ্গা সংকট
ঠেঙ্গারচরেই কি সমাধান?
পোপ ফ্রান্সিস যেদিন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে দেন, সেদিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরে সরকারি সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে বলেছে, ‘বিরান’ ও ‘অনুন্নত উপকূলীয়’ এ দ্বীপে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর পরিকল্পনা ‘অসম্ভব’ ও ‘নিষ্ঠুর’। সংস্থার মতে, কক্সবাজার থেকে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া হলে চলাফেরা, জীবনযাপন, খাদ্য ও শিক্ষার অধিকার থেকে এসব মানুষকে বঞ্চিত করা হবে।
পোপ ফ্রান্সিস ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের যেদিন এই বিবৃতি গণমাধ্যমে আসে, সেদিনই অর্থাৎ ৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত তিনটি দেশের হাইকমিশনার বলেন, স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা পেলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশ, অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত যেতে চায়। এর দিন কয়েক আগেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে গেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সদস্যরা, যাঁরা রোহিঙ্গা সংকটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছেন বলে তাঁদের তরফে দাবি করা হয়। তবে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে কমিশনের সদস্যরা বলেছেন, তাঁদের প্রতিবেদন তৈরি করতে এক বছর লাগবে।
ঠেঙ্গারচর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একঝলক দেখে নেওয়া যাক, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার বোঝা কত দিন ধরে বইছে। ইতিহাস বলছে, ১৯৪২ সালে গণহত্যার সময় পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা তৎকালীন পূর্ব বাংলা, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তারা কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯৫৮ সালে সরকারি মদদে মগসেনা ও স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্মী সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বৈঠকের পর বর্মী সরকার পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালেও নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার্মাকে চরমপত্র দেন এবং এসব উদ্বাস্তুকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় সে দেশের সরকার।
২০০৪ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির এক রিপোর্ট বলা হয়েছিল, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘ড্রাগং কিং’ অপারেশনের কারণে ১৯৭৮ সালে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৯১-৯২ সালে নতুন করে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আর গত বছরের অক্টোবরের সংকট শুরুর আগে ২০১২ সালেও সেখানে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। এরই মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায়, এমনকি দেশের অন্যান্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ সম্প্রতি বরিশাল থেকেও কয়েকজন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে পুলিশ।
রোহিঙ্গা সমস্যার দায় কোনোভাবেই বাংলাদেশের নয়। খোদ পোপ ফ্রান্সিস বলছেন, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের সংস্কৃতি আর ইসলামে বিশ্বাসের কারণেই সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ কোনোভাবেই এ সমস্যার দায় নিতে পারে না। তার পরও স্রেফ মানবিকতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ বরাবরই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের এ দেশে যতটুকু সম্ভব আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু সেই আশ্রয় দিতে দিতে এখন আসলে কত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছেও নেই।
বিভিন্ন ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বাইরে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা বের করতে একটি শুমারি হয়েছিল গত বছরের ২ থেকে ১৪ জুন। সেই শুমারির ফলাফল বলছে, বাংলাদেশে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা এক লাখ ৭৮ হাজার ৪০০ জন। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জাতীয় কৌশলপত্রের নমুনা জরিপ অনুযায়ী, এখানে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখ ৭৩ হাজার। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রতিবেদনও বলছে, বাংলাদেশ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দুই লাখ ৩১ হাজার। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ওই শুমারির ফলাফল নিয়ে। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মিলিয়ে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যাদের একটা বড় অংশই নাগরিক সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, এমনকি পাসপোর্ট নিয়ে পুরোদস্তুর বাংলাদেশের নাগরিক।
এ রকম বাস্তবতায় সরকার চাইছে নোয়াখালীর দ্বীপ ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে। এ উদ্যোগ আরো একবার নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আবেদীন ঠেঙ্গারচর পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি হেলিপ্যাড, একটি জেটি, গভীর নলকূপ নির্মাণসহ নানাবিধ বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) দিকনির্দেশনা দেন। দিন কয়েক আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দেবে। যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে তাদের কথার মিল নেই।
এরই মধ্যে গণমাধ্যমে ঠেঙ্গারচর বিষয়ে নানা খবর বেরিয়েছে। বলা হচ্ছে, বন্যাপ্রবণ এই জায়গাটি মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। এটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণও। তা ছাড়া এটি এখন বনদস্যু আর জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। এখানে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা কঠিন। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পরে তারা সেখানে কী করে জীবিকা নির্বাহ করবে? নিচু জমি বলে সেখানে সহজেই যে ফসল উৎপাদন করা যাবে, এমন নয়। আবার সবার পক্ষে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া মাছ ধরে সেই মাছ বিক্রি করতে গিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে তাদের কী ধরনের বৈরিতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে এখানে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পূর্বশর্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, যা খুবই কঠিন।
যদিও সরকার বলছে, এই স্থানান্তর সাময়িক। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার ফেরত না নেয়, তত দিন তারা ওখানে থাকবে। এটি আরও ভয়ংকর। কারণ, সাময়িক স্থানান্তর হলে সরকার সেখানে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তুলবে না। কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পকারখানাও সেখানে গড়ে উঠবে না। কারণ, সেই পণ্য বাজারজাত করা অত্যন্ত দুরূহ হবে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই সাময়িক স্থানান্তর বা একরকম নির্বাসনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সহায়তা দিতে চেয়েছে, তার অর্থ কি এই যে তারা সেখানে কক্সবাজারের মতো আরো কিছু ক্যাম্প তৈরিতে সহায়তা দেবে? কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কী রকম অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়, তা দেশের মানুষ জানে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ‘দেশহীন জাতির গল্প’ শিরোনামে একটি সিরিজ রিপোর্ট করেছিলাম ২০০৭ সালে, যা ছাপা হয় দৈনিক যায়যায়দিনে। ফলে এই ১০ বছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু বুঝেছি, তাতে এটা জোর দিয়ে বলতে পারি, ঠেঙ্গারচর কোনো সমাধান নয়। কারণ, মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্র যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে এবং রাখাইন রাজ্যে হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশ যদি ক্রমাগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে থাকে, তাহলে এটি মিয়ানমারকে নির্যাতনে আরো উৎসাহিত করবে। সুতরাং এর সমাধান প্রথমত মিয়ানমার সরাকারের রাজনৈতিক শুভবুদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মহলের ওপর, যারা শুরু থেকেই মিয়ানমারকে এ বিষয়ে চাপে রাখলে বাংলাদেশে এভাবে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসত না।
ব্যক্তিগতভাবে আমি অনেক রোহিঙ্গা নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরাও মনে করেন, তাঁদের জন্মস্থান রাখাইনে নিরাপত্তা পেলে তাঁরা বাংলাদেশে থাকবেন না। সাম্প্রতিক হামলার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোঙ্গিদের অনেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের সহযোগিতায় নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সহায়তার কথা বলছে, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকা দরকার এ কারণে যে এসব সহায়তার নামে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের স্থায়ী পথ তারা হয়তো এড়িয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সর্বোপরি প্রতিবেশী ভারত-চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যদি একযোগে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, এমনকি অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়, তাহলেই কেবল রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন বন্ধ হতে পারে। সেখানে জাতিগত নিধন বন্ধ না করে এখানে-ওখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আখেরে কোনো সুফল মিলবে বলে মনে হয় না।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।