ক্রিকেট
পরিণত বাংলাদেশের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ
ক্রিকেটের পুথিপত্র নিয়ে যারা চর্চা করেন তাদের নথিপ্রত্রে ডাবলিন নামটা ঢুকে পড়ল। বিশেষ করে ক্রিকেটীয় মনোজগৎটা যাদের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক। কারণটা খুব সহজ। গত ৩১ বছরে বাংলাদেশ আগে যা পারেনি ডাবলিনে তাই করে দেখাল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ আগে দেশের বাইরে জিততে পারেনি। ডাবলিনে কাঙ্ক্ষিত সেই জয় পেল। আইসিসি র্যাংকিংয়ে ছয়ে উঠে এলো। সেটাও বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার। আর এত অর্জন যে জায়গায় সেই ডাবলিন কেন ঢুকে পড়বে না বাঙালির মনোজগতের ক্রিকেট জাদুঘরে!
হ্যাঁ, হায়দরাবাদ-নর্দাম্পটন-কার্ডিফ-পোর্ট অব স্পেন- গায়ানা-অ্যাডিলেড বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক সাফল্যগাঁথার সাক্ষী। ডাবলিনে কিউই বধের স্মৃতি দ্বারা হয়তো একদিন বাঙালি আক্রান্ত হবে। কিন্তু সেটা তো নস্টালজিক ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য দূরবর্তী ভবিষ্যতের কথা। তবে নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ আইসিসি ট্রফিতে মনে রাখার মতো কিছু করা।
ইতিহাসের সরণি দিয়ে হাঁটলে একদিন হয়তো বলা যাবে আইসিসি ট্রফির শেষযাত্রায় বাংলাদেশও ছিল। শেষযাত্রা ছাড়া কী! এটাই তো আইসিসি ট্রফির শেষ আসর। ওভালে কেউ হয়তো ট্রফি জিতে উল্লসিত হবে। উচ্ছ্বাসে ভাসবে। সেই দলটার নাম বাংলাদেশ হলে তারা একটু শোকস্তব্ধ হয়ে পড়তে পারে। উদযাপণটা হতে পারে বিহ্বলতা জড়ানো! কারণ, টুর্নামেন্টের ধাত্রীভূমি যে বাংলাদেশ। ১৯ বছর আগে গত সহস্রাব্দের শেষ দিকে ঢাকায় যাত্রা শুরু হয়েছিল এই টুর্নামেন্টের ‘মিনি বিশ্বকাপ ’ নামে। পরে যার পোশাকী নাম হয়ে গেল আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আর সেই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে দাড়ি পড়বে ইংল্যান্ডে। এই টুর্নামেন্ট বাংলাদেশের জন্য একদিকে আনন্দের। অন্যদিকে বিষাদ মেশানো এক গল্পও। কারণ, টুর্নামেন্টের প্রথম আসরে শুধু আয়োজক হয়ে থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ওয়ানডে স্ট্যাটাস থাকলেও নন টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি। তাই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অংশ গ্রহণের ছাড়পত্র ছিল না। সেদিন অবশ্য সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিল বাংলাদেশ। টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি না হয়েও এক হোটেলে নয়টা টেস্ট প্লেয়িং দেশকে রেখে, একই মাঠে এত বড় একটা টুর্নামেন্টের সফল আয়োজন করে। এর পরের তিনটা আসরে অবশ্য বাংলাদেশ খেলেছিল। তারপর আবার আইসিসির র্যাংকিংয়ের মাপকাঠিতে চ্যাম্পয়িনস ট্রফিতে খেলার যোগ্যতা হারায়। ১১ বছরের হতাশা কাটিয়ে যোগ্যতা দিয়ে বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি খেলতে যাচ্ছে। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডকে ডাবলিনে ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ ম্যাচে হারালো। তবে নিউজিল্যান্ডকে হারানোকে ক্রিকেট বিশ্ব এখন আর ‘অঘটন’ বলতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশ দলের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স। আর তাই আইসিসি র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ছয় নম্বরে উঠে আসাও এখন আর কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়। পুরোটাই গাণিতিক এবং সেটা ধারাবাহিকভাবে যোগ্যতা প্রমাণ করে।
তারপরও ইংল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রমাণ করার অনেক কিছু আছে। সেই অনেক কিছু মানে ভালো ক্রিকেট খেলা যেমন, তেমনি ম্যাচ জেতা। ভালো ক্রিকেট খেলার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামা আর হারা, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেই যুগের অবসান ঘটেছে। হার নয়। বাংলাদেশ এখন অন্যদের হারানোর জন্য মাঠে নামে। হারকে ঘৃণা করতেও বোধহয় শিখেছে। আর এই শিক্ষাটাই অভিজ্ঞতা। দল হিসেবেও বাংলাদেশ এখন অভিজ্ঞ। এই টিমটা এখন আর কোনো আশরাফুল নির্ভর দলও নয়। যে তাঁর ব্যাট ঝলসে উঠলে উচ্ছ্বাসে ভাসবে বাংলাদেশ। কেঁপে উঠবে ক্রিকেট বিশ্ব! এই দলটা আইসিসি র্যাংকিংয়ে ছয় নম্বরে থাকা দল। যাদের আবার আইসিসি র্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা দ-একজন ক্রিকেটারও আছেন। সেই বাংলাদেশ যদি ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড,অস্ট্রেলিয়ার ওপর ক্রিকেটীয় মাস্তানি দেখায় তাতে ক্রিকেট বিশ্ব কেঁপে উঠবে না। ক্রিকেটপ্রেমীরা বিস্মিতও হবেন না।ওসব দলকে বাংলাদেশ হারালে ক্রিকেট গ্রহে এখন তা স্বাভাবিক ঘটনাই হবে। বাংলাদেশ এখন অভিজ্ঞ আর পরিণত একটি দল। তার প্রতিফলন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবলিনে আরো একবার দেখা গেছে।
ব্যক্তি থেকে দল। সব জায়গায় পরিণত মানসিকতার প্রতিফলন। সেখানে প্রতিপক্ষের ওপর ঔদ্ধত্য যেমন দেখাছেন ক্রিকেটাররা তেমনি দলের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতাও থাকছে। শৃঙ্খলা, ধৈর্য আর বিচক্ষণতাও ধরা পড়ছে তাঁদের ক্রিকেটে। বাংলাদেশ আগে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার পেয়েছে। কিন্তু হার এড়িয়ে ম্যাচ জেতানো দল পায়নি। এবার পেয়েছে। ইংল্যান্ডের মাটিতে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির মতো একটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্টকেই পাচ্ছেন নিজেদের প্রমাণ করার জন্য আদর্শ সুযোগ হিসেবে।
লেখক : সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক