ক্রিকেট
হৃদয়ে রাখি বাংলাদেশ
চারপাশে এত হঠকারিতা, ব্যর্থতা, দুর্নিবার প্রতারণা, অসততা ও অন্যকে ঘায়েল করবার ফন্দিফিকির দেখতে দেখতে যখন নিজেদের আশাবাদের শেষ শলতেটাও নিভে যায় যায়, সেসময় বাংলাদেশের ক্রিকেটটা সেই প্রায় নিভে যাওয়া কুপিতে এক অনন্য দীপশিখা জ্বালিয়ে যায়। বাংলাদেশের নিষ্ঠাবান তরুণ ক্রিকেটাররা আমাদের বিষণ্ণ মুখগুলো রাঙিয়ে দিয়ে যায়; অনিয়মিত হৃদয়ের স্পন্দনটা সারাই করে দিয়ে যায়।
বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ এবং নীতিনির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্তের যাঁতাকলে পড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রায়ই মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেয়। এই তো এখন চলছে পাহাড়ের কান্না। পাহাড়ের অভিমানে শতাধিক প্রাণের অকাল প্রয়াণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সবার বুকে। তবু সেই কারুণ্য ছাপিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি ২০১৭-এর সেমিফাইনালটাও আমাদের মনে শিহরণ জাগাচ্ছে ঠিকই। আমরা প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের সর্বোচ্চ কোনো আসরে সেমিফাইনাল খেলছি। তাও আবার সোয়াশ কোটি মানুষের দেশ ভারতের মতো ক্রিকেট পরাশক্তির সঙ্গে!
আগে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হলে উত্তেজনার পারদ উঠত ব্যারোমিটারের সর্বোচ্চ পয়েন্টে। আর এখন পারদ উঠানামার ব্যাপারটি পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে ভারত-বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বড় আসরে ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি হলেও সেসব ম্যাচে জয় লাভ করেছে ভারত। কিন্তু হেরেছে ক্রিকেট। অভিযোগ আছে, ভারতের পক্ষ নিয়ে আইসিসি, বোর্ড প্রেসিডেন্ট, আম্পায়াররা প্রায় প্রকাশ্যে ভারতের পক্ষপাতিত্ব করে। এর সর্বশেষ উদাহরণ ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ ১০৯ রানে হারলেও সবার ধারণা জোর করে বাংলাদেশকে হারের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর ‘চক্ষুলজ্জা’ নিয়ে এখনও আলোচনা হয়। সেসময় সেসব ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আইসিসি’র বাংলাদেশি প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত পদত্যাগ করেছিলেন। খেলাকে শেষ পর্যন্ত স্রেফ খেলাতেই রাখতে হয় এবং পুরনো কাসুন্দি ঘেটে কোনো লাভ হয় না তবু বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচ হলেই সেসব পুরোনো হিসাব-নিকাশ চুকানোর বিষয়টি এসেই যায়। কারণ সারাবিশ্বের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা বিশ্বাস করেন, ভারতের রয়েছে বিশাল ক্রিকেট বাণিজ্য। সেই বাণিজ্যের অর্থকড়ি দিয়েই আইসিসির মতো সংগঠন চলে। তাই ঘুরিয়ে পেচিয়ে হলেও হর্তাকর্তাদের সেই বাণিজ্যের পক্ষে থাকতে হয়। কার্যত এরফলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান দেশ কোনো হাইভোল্টেজ ম্যাচে খেলতে নামলে শুধু মাঠের প্রতিপক্ষ ১১ জন খেলোয়াড়কে মোকাবিলা করলে চলে না, তাদের মোকাবিলা করতে হয় আরো অনেক কিছুকে।
আজকাল ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে দুইদেশের মিডিয়াতেই তুমুল যুদ্ধ চলে। টুইটার-ফেসবুকে কে কী বলল, কী ট্রল করল, খেলোয়াড় বা দেশের জাতীয় পতাকার অপমান হলো কি না, এসব নিয়ে লেখালেখি চলতে থাকে। সরগরম থাকে টিভির খবর বা টকশোওয়ালারাও। স্বাভাবিকভাবে ভারতের মিডিয়া হাউসগুলো বড় বলে বিশেষ করে ইংরেজি গণমাধ্যমগুলোর কল্যাণে তা বিশ্বব্যাপী ছড়াতে সময় লাগে না। সেসব অবস্থাদৃষ্টে তারকা খেলোয়াড়দের সংবাদ সম্মেলনে এসে ভক্তদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানাতে হয়।
এমন একটা পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের বীর ক্রিকেটাররা যা কিছু অর্জন করে দেখাচ্ছে তাতে সব ক্রিকেটভক্ত ও অনুরাগীর মনে আশাবাদের জায়গাটা সৃষ্টি না হওয়া রীতিমতো অপরাধ।
আজকের বার্মিংহামের এজবাস্টন যদি বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্য ধরা দেয়, নিঃসন্দেহে আনন্দে উদ্বেলিত হবে সবাই। সৌভাগ্য যদি মুখ ফিরিয়ে রাখে তাতেও আমাদের অর্জন ম্লান হবে না এতটুকু। মনে রাখতে হবে সাউথ আফ্রিকার মতো র্যাংকিংয়ে এক নম্বর দল বা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো ক্রিকেট পরাশক্তিরাও গ্রুপ পর্যায় দিকে বিদায় নিয়েছে। কে বলতে পারে, আজকের সেমিফাইনালের বিদয়টাও কোনো বড় ভাইয়ের কপালে লেখা থাকবে না? আমরা জিতবার আশা করার আগে চাই, ভয় ডরহীন একটা জমজমাট ম্যাচ। খেলাটা নাহোক অসহায় আত্মসমর্পণ। আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি, পরাজয়ে ডরবে না বীর মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ, তাসকিন, মুস্তাফিজরা।
আমাদের হাজার সংকট আর দুর্বিপাকে আছে ওই ক্রিকেটটাই। সব বাদবিসংবাদ পেছনে ফেলে আমরা সবাই এক হই ওই ক্রিকেটেই। কিন্তু হায় ক্রিকেটের মতো করে দেশের অপরাপর রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক সংকট সমাধানেও যদি এক হতে পারতাম! তবেই আমরা পস করতাম দেশপ্রেমের পরীক্ষায়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট একটা খেলাই। ক্রিকেট মাঠে যা করবার ১১ জন খেলোয়াড় এবং পেছন থেকে নীতিনির্ধারকরা করবেন। কিন্তু হাওরের মানবসৃষ্ট বন্যায় চালের মূল্য দ্বিগুণ হওয়া, স্বল্প বৃষ্টিতেই ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে মহাসাগর নামা কিংবা পাহাড়ের ক্ষুব্ধতায় অকালে ঝড়ে পড়া দেড় শ প্রাণ, এসব সংকটের সমাধান ক্রিকেট দিয়ে হবে না! ক্রিকেট বিনোদনের ষষ্ঠী হতে পারে বেঁচে থাকবার অবলম্বন নয় কিছুতেই।
শুধু ক্রিকেট নয়, আমাদের ঐকমত্য থাকতে হবে ত্যাগ, সততা, কর্মনিষ্ঠা ও সুশাসনে। তবেই ক্রিকেটের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিরা আমাদের মনকে হঠাৎ বিষনণ্ণতায় ফেলবে না বা আনন্দসায়রে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে না। কাজেই শুধু ক্রিকেট নয়, হৃদয়ে যেন রাখি জেগে দেখা সুন্দর স্বপ্নের গোছানো বাংলাদেশ। গোছানো সেই ভালোবাসার বাংলাদেশ থেকে আমাদের ক্রিকেটের সুবর্ণপুত্রদের জন্য অশেষ শুভকামনা।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন