ক্রিকেটের কষ্ট কি মানুষের কষ্টের চেয়ে বড়?
বাংলাদেশের বহু মানুষের জন্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটা একটা ব্যাপার ছিল। আমাদের অনেকের জন্যই এটা ছিল গৌরব অর্জনের সুযোগ। বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল জয়-পরাজয় মেশানো একটা সাম্প্রতিক অতীত নিয়ে। পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে সমীহ আদায়ের এটা একটা সুযোগ ছিল।
ওই টুর্নামেন্টে গিয়ে আমরা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি, ইংল্যান্ড ও ভারতের কাছে হেরেছি এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। নানা সমীকরণ, হিসাব ও আমাদের যোগ্যতা সেমিফাইলে নিয়ে যায়। যোগ্যতর দল হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে পরাজিত করে ফাইনালে গেছে, তাদের শুভেচ্ছা।
এসব যখন হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগে শত শত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। পার্বত্য এলাকা ও হাওরাঞ্চলের মানুষ ব্যাপক কষ্টে রয়েছে। খাদ্যকষ্টে ভুগছে অসংখ্য মানুষ। তার ওপর আছে বাজেটের চাপ। ক্রিকেটে উৎসাহ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ মানুষের কষ্টগুলো চোখে এত কম লাগল কেন?
২. ক্রিকেটপ্রেম কি আমাদের সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে আমাদের আগ্রহ সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে? দিনের পর দিন গণমাধ্যমগুলো ক্রিকেট নিয়ে খবর ছাপাচ্ছে। কী হতে পারে, না হতে পারে—তা নিয়ে কথা বলছে। সাধারণ মানুষের জগৎ আর ক্রিকেটপ্রেমীদের জগৎ যে কতটা আলাদা, সেটা প্রতিদিন লক্ষ করছি। কিন্তু কীভাবে এই পরিস্থিতিটা তৈরি হলো সেটা ভাবছি না। গণমাধ্যমের নিজস্ব কোনো ভাবনা থাকে না। তারা গণমাধ্যম ভোক্তাদের জন্য তথ্য, আবেগ, অনুভূতি ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। তার মানে কি এই নয় যে, আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা প্রধানত ক্রিকেটপ্রেমী তাদের কাছে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের চেয়ে ক্রিকেটে কে জিতল, কে হারল সেটা বড় হয়ে গেছে? এটা কেমন দেশপ্রেম?
৩. বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে, এটি এমন একটি খেলা যেখানে আমরা কেবল ২০-৩০টা দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে একটা সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে পারি। ক্রিকেট খুব অল্প সংখ্যক দেশের মানুষ খেলে। প্রধানত সেই সব দেশ হচ্ছে, কোনো না কোনো সময় যারা ইংরেজ উপনিবেশের অধীন ছিল। সেটা অস্ট্রেলিয়াই হোক বা জিম্বাবুয়ে। আমরা তো ছিলামই। সেটা ভালো কথা, আমরা একটা পরিসর পেয়েছি যেখানে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কোন ম্যাজিকের মাধ্যমে আমাদের চোখের সামনে এই পর্দাটা নেমে এলো, যাতে করে এ দেশের স্বাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতে পারলাম?
৪. ক্রিকেটপাগল আমি নিজেও। কিন্তু এটা তো আমার জীবনের প্রধান বিষয় হতে পারে না। যখন পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধসে মানুষ মারা যাচ্ছে, একটি জনপদের জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যখন বহুদিন পর দেশে খাদ্য আমদানি করার চেষ্টা চলছে, যখন জিনিসের দাম নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, চালের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা; তখন ক্রিকেট এত বড় জায়গা করে নেয় কেন?
সত্তর দশক থেকে ক্রিকেট ফলো করছি, যখন আমরা ছিলাম বিশ্বের কাছে হাসির পাত্র। আর আজকে আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেললাম। সবার সঙ্গে আমরা গর্বিত। বিষয়টা খেলা নিয়ে নয়, বিষয়টা আমাদের আগ্রহের পরিসরটা নিয়ে। আমাদের নিজেদের শরীরে আর মনে আমরা কোন বর্ম জড়িয়েছি যে আমাদেরকে গরিব মানুষের কষ্ট প্রায় ছোঁয় না? কিন্তু ক্রিকেট সুখ-দুঃখ ছোঁয়।
৫. আমরা হাওর অথবা পাহাড়ধস নিয়ে দলীয় রাজনীতি খুঁজি। কোনো ঘটনা ঘটার পর বিএনপি-আওয়ামী লীগের ঝগড়াঝাঁটি এবং বক্তব্য নিয়ে মেতে উঠি। কিন্তু সেটা করি আমাদের নিজেদের অবস্থানকে সবল রেখেই। আমাদের কণ্ঠে রাজনৈতিক স্লোগান ছাড়া কোনো কথা আসে না। আমাদের রাগ-দুঃখ হয় কোনো না কোনো দলের দিকে তাকিয়ে। ক্রিকেট সম্পর্কে আমরা ভারত-পাকিস্তান নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ভরিয়ে ফেলি। কিন্তু গরিবের বিষয় নিয়ে আমরা সরব নই। এ কারণেই আমাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যবধানটা এতটা ব্যাপক ও গভীর হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ওডিআইতে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। ক্রিকেট দলকে অভিবাদন। আর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যারা এত দুর্যোগের মধ্যেও ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি করতে পারে, তাদের দেশপ্রেমিক হিসেবে আমরা কত নম্বরে রাখব?
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক