অভিমত
বাংলাদেশে নারী ক্রিকেট ও আমাদের আবেগ
আবেগ মাপার ব্যারোমিটার কী? বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মনে এই প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে। তবে বাঙালির আবেগ মাপতে কোনো যন্ত্রটন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে কি? মনে হয় না। কারণ, সাদা চোখেই দেখা যায় বাঙালির আবেগের স্রোত। সেই আবেগ বেশির ভাগ সময় অন্ধ হয়ে কাজ করে এবং সেটা যুক্তিকে পেছনে ফেলে। আর সেই আবেগের গায়ে যদি ক্রিকেট নামক খেলার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রলেপ লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তো কথা নেই। সবাই তখন প্রশ্নাতীতভাবে সেই আবেগ প্রকাশের চেষ্টা করে। সেটা সামাজকি যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সর্বত্র। মনে হয় বাকি পৃথিবীকে বাঙালি দেখাতে চায়, দেখ, ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আবেগ দিনে দিনে প্রবল থেকে কীভাবে প্রবলতর হচ্ছে। ক্রিকেট তোমাদের কাছে খেলা হতে পারে। আমাদের কাছে তারচেয়ে বেশি কিছু। তাই বাংলাদেশ মাঠে নামা মানে ছাপান্না হাজার বর্গমাইলে আবেগের জোয়ার বয়ে যাওয়া। প্রবল আবেগের সেই জোয়ারে ভাসে ষোল কোটি বাঙালি।
কিন্তু বাস্তবতা কত রুঢ়! আবেগের প্রবল জোয়ার যেখানে, সেই ভূখণ্ডেই আবার আবেগের খরা! তখন মনে হয় ষোল কোটি মানুষের মনে আবেগের কী আকাল! এবং সেটাও ক্রিকেট নামক একটা খেলাকে ঘিরে। তার মূল কারণ, বাঙালি এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বাঙালির কাছে ক্রিকেট মানে এখনো এগারজন পুরুষ লাল-সবুজের মোড়কে মাঠে নামবে। তারা জিতলে গোটা দেশ উচ্ছ্বাসে ভাসবে। হারলে গোটা দেশ হতাশ হবে। কেউ কেউ আবার আইসিসি নামক সংস্থাটির কর্তাদের ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়াবে। বাঙালির ক্রিকেট মানে হতে হবে ‘ছিইলা-কাইটা লবণ লাগাইয়া দিব’ মার্কা পৌরুষের প্রকাশ! আর না পারলে ম্যাচের মধ্যে অন্য কোনো দেশের ক্রিকেট কর্তাদের ষড়যন্ত্রের কালো হাত আবিষ্কার করা! এই ‘কালো হাত’ আবিষ্কারের পেছনে আছে কোনো কোনো দেশের দাদাগিরি। কোনো কোনো দেশের বড় ভাই সুলভ আচরণ। তবে এসব আবিষ্কারের পেছনে আছে আরো কিছু কারণ। সেগুলো রাজনৈতিক। ভৌগোলিক এবং অবশ্যই অবশ্যই ইতিহাসজনিত।
কারণ যাই হোক, বাঙালিকে কে বোঝাবে ক্রিকেট নামক খেলাটা এখন শুধু পুরুষদের একমাত্র খেলা নয়। আইসিসি শুধু পুরুষদের বিশ্বকাপ আয়োজন করছে না। শুধু পুরুষদের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের সীমাবদ্ধ থাকছে না আইসিসির সংক্ষিপ্ত সংস্করণের ক্রিকেটও। সেখানে বিভিন্ন দেশের নারীরাও বিশ্বকাপ খেলছে। টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলছে। কিন্তু নারীদের এই সব টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ শুধুই দর্শক! কেন তারা মূল প্রতিযোগিতায় খেলতে পারছে না, তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা কী আছে?
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের আক্ষেপ থাকতে পারে, তারা বিশ্বকাপে খেলতে পারছে না। কিন্তু কেন পারছে না? সেই কারণটা কী খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে? জোর দিয়ে ক্রিকেট কর্তারা বলতে পারবে না, তারা ঠিকঠাক মতো নারী ক্রিকেটদের দিকে নজর দিচ্ছে। বরং পুরুষদের সাফল্যের মধ্যে দিয়ে গোটা জাতিকে তারা ভুলিয়ে রাখতে চাইছে নারী দল পারছে না তাতে কী! আমাদের ক্রিকেটররা আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ক্রিকেট সঠিক পথেই আছে। হয়তো তাই। কিন্তু সেটা তো শুধু পুরুষদের ক্রিকেটে। নারী ক্রিকেটের চেহারাটা কী খুব স্বাস্থ্যকর মনে হচ্ছে? যদি তাই হবে তাহলে বিসিবির ক্রিকেট আপারেশনস কমিটির এক সাবেক চেয়ারম্যান কেন বলবেন, ‘উইমেন্স ক্রিকেটটাকে যখন একটা সেপে নিয়ে আসা গিয়েছিল তখন নতুন করে মহিলা ইনিংসের কমিটি গঠন করা হলো। নতুন চেয়ারম্যান। নতুন ম্যানেজার। কিন্তু রেজাল্ট?’
রেজাল্ট কী আর বাতাসে ভেসে এসে ধরা দেবে? মোটেও তা নয়। পুরুষ ক্রিকেট নিয়ে পরিকল্পনা এই শতাব্দির গোড়ার দিকে। যার ফসল সাকিব-তামিম-মুশফিক। আর তাঁরা পারফর্ম করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ জিতছে। আমরা আনন্দে ভাসছি। বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াচ্ছি আমাদের ক্রিকেট এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সরাসরি খেলবে। কিন্তু কেউ কি শুনেছেন আগামীতে কবে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারবে। কিংবা তাদের বিশ্বকাপ খেলার জন্য কী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশজ ফুটবলে যখন খারাপ অবস্থা, তখন অন্ধকারের মাঝেও আলো জ্বালছেন কৃষ্ণারা। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন, ছেলেরা না পারলেও ফুটবলে আমাদের মেয়েরা পারছে। হ্যাঁ, কিছুটা তো পারছে। কিন্তু ফুটবলের তুলনায় ক্রিকেটে সুযোগ- সুবিধা, অর্থ-কড়ি সবই বেশি। কিন্তু নারী ক্রিকেটাররা পারছে না কেন? উত্তর যাই হোক, সময় এসেছে এই না পারার রহস্য খুঁজে বের করার।
নারী ক্রিকেটের গতিপথ বদলানো জরুরি। তার জন্য বেশি দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। নারীরা আর কতটা কী পারবে! এ রকম একটা আস্থাহীনতায় ভোগে গড়পড়তা বাঙালি। সাফল্যই পারে তাদের আস্থা ফেরাতে। সালমা খাতুনরা অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছেন কি না, সেটা দেখার সময় এসেছে। ভাবার সময় এসেছে নতুন নারী ক্রিকেটার কেন উঠে আসছে না। কিংবা তাদের তুলে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখাও জরুরি। তা না হলে নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে শুধু দর্শক হয়েই থাকতে হবে। এ দেশের মানুষ হয়তো ভুলে যাবে নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেট বলে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্ট আছে। ভুলে যাবে, পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরুরও আগে শুরু হয়েছিল নারী বিশ্বকাপ ক্রিকেট!
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পুরুষদের বিশ্বকাপে কিছু সাফল্য কিংবা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খুঁচখাচ সাফল্য দিয়ে নারী ক্রিকেটে সাফল্য না পাওয়ার আক্ষেপ চেপে রাখা যাবে কত দিন! নারী ক্রিকেট নিয়ে বাঙালি আবেগহীন। নারী ক্রিকেট তাদের কাছে রংহীন। একেবারেই সাদাকালো। আবেগটাও যেন খানিকটা বায়বীয়। কিন্তু সেই বায়বীয় আবেগ কি কোনোদিন সাফল্যের ছোঁয়ায় জমাট বাঁধবে না! অথবা সেটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে না! ক্রিকেট বিশ্বের কাছে আপাতত একটাই প্রার্থনা, বাঙালির এই আবেগের খরা কাটাতে, নারী ক্রিকেটে সাফল্য দাও।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি