অভিমত
মুশফিক কি শুধুই নিলামের ক্রিকেটার?
মুশফিকুর রহিম। শুধুই কি বিপিএলের নিলামে তোলা একজন ক্রিকেটার! না কি তাঁর আরো পরিচয় আছে? প্রথমত মুশফিক একজন ব্যক্তি। জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটার। বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। শুধু অধিনায়ক নন, টেস্টে বাংলাদেশের সফল অধিনায়ক। বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের স্মরণীয় দুটো জয় তাঁর অধিনায়কত্বে। আবার কিছু দিন আগে তিন ফরম্যাটেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। সেই লোকটাকেই বলা হলো ‘হি ইজ নট অ্যা গুড ক্যাপ্টেন!’ এবং বললেন কে? ভদ্রলোকের বড় পরিচয় তিনি বরিশাল বিভাগীয় কোটায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক। স্বার্থ সংঘাতের সংজ্ঞা ভুলে আবার তিনি বিপিএলে ‘বরিশাল বুলস’-এর একজন কর্মকর্তা। মুশফিকের দিকে কিছু শব্দবাণ ছুঁড়ে দিয়ে হঠাৎ করে তিনি মিডিয়ার আলোচনায় এলেন।
ধন্যবাদ দিতে হবে ভদ্রলোককে। মিডিয়া কাভারেজের জন্য তিনি মাঝেমধ্যে কিছু একটা করেন। এবারও করলেন। এবং তাঁর বক্তব্যে বেরিয়ে পড়ল ক্রিকেটীয় রুচি, সংস্কৃতি, শিষ্টাচারবর্জিত কিছু লোকও আছেন বাংলাদেশে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদে। যাঁরা বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ককে অপমান করতে দ্বিতীয়বার ভাবেন না। ভাবতে পারেন না। ভাবার মতো চিন্তা শক্তি তাঁদের নেই। আবার তারা জানেন না, মুশফিকের অধিনায়কত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে ছোট করা হলো বোর্ড সভাপতি থেকে শুরু করে বোর্ডের গোটা পরিচালনা পর্ষদকে। কারণ, মুশফিককে অধিনায়কের দায়িত্ব দিয়েছে বিসিবি। কোন একজন আবদুল আওয়াল নন। আর মুশফিক ভালো অধিনায়ক নন, এটা যদি তার বিশ্বাস হয়, তাহলে সেটা তিনি আম-আদমি হিসেবে করতেই পারেন। তবে মিডিয়ার সামনে মুশফিকের অধিনায়কত্বের সমালোচনা করতে হলে, তাঁর উচিত ছিল বোর্ড থেকে পদত্যাগ করে তারপর বলা। অথবা পরিচালনা পর্ষদের সভায় বলা। তিনি শুধু মুশফিককে ‘আহত’ করেননি, করেছেন পুরো টেস্ট দলকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট সমাজকে। বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ককে অসম্মান করেছেন দেশের মানুষের সামনে।
মুশফিক ভালো অধিনায়ক নন। তাহলে কেন মুশফিককে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অধিনায়ক করেছে! বোর্ড পরিচালক হিসেবে মিস্টার আবদুল আওয়াল বুলুরই উত্তরটা দেওয়া উচিত। মুশফিকের অধিনায়কত্বের সমালোচনায় যে উচ্চস্বর তাঁর কণ্ঠে ছিল, সেটা আবার একটু ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বোর্ড পরিচালক হিসেবে নয়, তাঁর বক্তব্যটা বরিশাল বুলসের কর্মকর্তা হিসেবে! ভালো কথা। কিন্তু শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়? বরিশাল বুলসের কর্তা হিসেবে তিনি যা বলেছেন, সেটা দ্বিতীয়বার শুনে দেখার সুযোগ ভদ্রলোকের আছে। সেটা ভিডিও ফুটেজের সৌজন্যে। দ্বিতীয়বার ভাবার সুযোগও আছে। বরিশাল বুলসের কর্তা হিসেবেও কি তিনি কথাগুলো মিডিয়ায় বলতে পারেন?
তবে এটাও নিশ্চিত করে বলা যায়, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থবার ভাবার সুযোগ থাকলেও তিনি তা ভাবতে পারবেন না। তারপরও খুব বিনয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, আপনি যখন জানতেন মুশফিক আগেরবার সিলেট দলে থাকতেও দলের জন্য ভালো কিছু করেনি কিংবা আপনার ভাষায় ‘ইনডিসিপ্লিন’ ছিলেন, তাহলে তাকে কেন আপনাদের মতো একটা ‘ডিসিপ্লিন’ দলের অধিনায়ক করলেন? আবদুল আওয়ালদের বক্তব্য কী হবে জানি না। তবে এইটুকু জানি তিনি মিডিয়ায় মুশফিককে নিয়ে যা বলেছেন, তা মুশফিকের মতো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ক্রিকেটারকে আহত করবে। হতাশ করবে। তিনি ক্ষুব্ধ হবেন। মুশফিক সেই হতাশা আর ক্ষোভ প্রকাশের জন্য সংবাদ সম্মেলনই করলেন। এবং সেটা বিসিবির প্রধান নির্বাহী এবং বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিবকে পাশে বসিয়ে।
একজন মুশফিক আর একজন আবদুল আওয়ালের মধ্যে পার্থক্য শুধু বগুড়া আর বরিশালের দূরত্বের নয়। তাদের চিন্তা-ভাবনা-রুচি-জ্ঞানের দূরত্ব কয়েক হাজার মাইলের। সেটা তো মুশফিকের সংবাদ সম্মেলনেই বোঝা গেল। মুশফিক বুঝিয়ে দিলেন। হতাশ, আহত মুশফিক আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। ভেঙে পড়লেন কান্নায়। সংবাদ সম্মেলনের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রশ্ন রেখে গেলেন, এতদিন দেশকে সার্ভিস দিলাম...! তাঁর অসমাপ্ত বাক্যের শেষ অংশের উচ্চারণ কী হতে পারত সেটা এ দেশের মানুষ বুঝতে পারেন। কারণ তাঁর ভাবনার ক্ষেত্র, কর্মপরিচয়ের কারণে এ দেশের মানুষ তাঁর কথা গুরুত্বসহকারে শুনবেন। শুনতে চাইবেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যিনি অভিযোগ তুললেন তাঁর কথা? তাঁর কথা শুনবে বিসিবি। তবে তা হতে পারে কারণ দর্শানোর নোটিশের বয়ানে। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিকের কথায় তেমনই ইঙ্গিত। কারণ তিনিও বললেন, বরিশাল বুলসের কর্তা হয়ে বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ককে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কারো নেই।
হয়তো নেই। সেটা একজন বোর্ড পরিচালকের জানার কথা ছিল। কিন্তু একজন বোর্ড পরিচালক কাম ফ্রাঞ্চাইজি কর্তা যা বলেছেন, তাতে মুশফিকের সম্মান নষ্ট হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সম্মান নষ্ট হয়েছে। তারপরও যৎসামান্য যা আশা, তা অবশ্য শোনা গেল মুশফিকের প্রেস কনফারেন্সে মল্লিকের কণ্ঠে। ‘বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়ককে ইনডিসিপ্লিন বলার অধিকার কোনো ফ্রাঞ্চাইজি মালিকের নেই...’ বিসিবির যা বলার তা তারা বলছে। কিন্তু যা করার তা করবে কি না তা নিয়ে সংশয় থাকছে। শঙ্কা জাগছে, যতটা গর্জন ততটা বর্ষণ হবে তো! নাকি পুরোটাই হয়ে থাকবে গুরুত্বহীন এক হুঁশিয়ারি। কারণ, বিপিএল যেখানে স্বার্থ-সংঘাত বলে কোনো শব্দ নেই! আছে অক্রিকেটীয় স্বার্থ আর রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি