প্রতিক্রিয়া
অধিনায়কের খেলা, অধিনায়ক নিয়ে খেলা
বাংলাদেশের ক্রিকেটে নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রশ্নের ডালপালা মেলে। টেস্টে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের কাছ থেকে ক্যাপ্টেনের ব্যাটনটা কেড়ে নেওয়া হবে, তার একটা পূর্বাভাসও বিভিন্ন সূত্রে আমাদের কানে এসেছিল।
বিশেষ করে, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে আসায় এবং সেই সফরে দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যে বলায় বোর্ড সভাপতি মুশফিকুর রহিমকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতেই এ বিষয়ে একটা ফয়সালা দেখতে পাচ্ছিলেন ক্রিকেট বোদ্ধারা। কিন্তু তা কবে হবে, সামনের সিরিজেই কি না, এ নিয়ে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। শেষ পর্যন্ত রোববার বিকেলে ফয়সালাটা হয়েই গেল।
প্রশ্ন হলো, রোববার বিকেলেই কেন এ সিদ্ধান্ত নিতে হলো এবং ঢাক পিটিয়ে তা জানাতেও হলো। এদিন বিকেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের যে সভা বসেছিল তাতে সামনের সিরিজের জন্য দল ঘোষণার কোনো বিষয় ছিল না। অধিনায়ক যদি কাউকে নতুন করে করতেই হয় সেটি তো সিরিজ উপলক্ষে দল ঘোষণার যে নির্দিষ্ট সময় থাকে, তখনো করা যেত এবং প্রকাশ করা যেত। এত তাড়াহুড়া কিসের?
সাকিব আল হাসানের হাতে টেস্ট অধিনায়কের ব্যাটনটা ফিরিয়ে দিতে গিয়ে বিসিবি কি একটু তাড়াহুড়াই করে ফেলল না? কিছু প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই যেন বিসিবির নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, গতকাল বিপিএলের দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে বৃষ্টি হলে কী হবে, তা আগেই ঠিক করা আছে। তারপরও নতুন করে উপস্থিত নিয়ম বানিয়ে খেলাটা পরের দিনে নিয়ে যাওয়া হলো। কেন? এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রিজার্ভ ডে আগে থেকেই কেন রাখা হলো না? যদি রাখা নাই হলো, এখন কেন রিজার্ভ ডে-তে খেলা হবে? এটা কি মামার বাড়ির আবদার, যখন যা ইচ্ছে তাই করা হবে?
বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান অধিনায়ক হিসেবে যে খারাপ চয়েস তা কিন্তু নয়। নামে এবং ভারে দুটোতেই কাটতে পারবেন তিনি। মুশফিকের পরে স্বাভাবিকভাবে তাঁর নামই অধিনায়ক হিসেবে আসার কথা। দলে সিনিয়রিটি এবং খেলার মাঠের অভিজ্ঞতা বিবেচনায়ও অধিনায়কত্ব তাঁর সঙ্গে যায়। কিন্তু সময়ের আগেই এক ধরনের মরিয়া হয়ে তাঁকে অধিনায়ক ঘোষণা করার পেছনে কী মারফতি বিষয় আছে তা বোঝা গেল না। বোঝা গেল এইটুকুন যে, দেশের ক্রিকেটের জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ এই সিদ্ধান্তটা এসেছে অনেকটা অপ্রত্যাশিত সময়ে।
সময় এবং প্রক্রিয়া যেমন প্রত্যাশিত নয় তেমনি আমার কাছে (হয়ত অনেকের কাছেই) সিদ্ধান্তটাও খুব একটা এখনই প্রত্যাশিত কিছু হয়নি। খেলার জগতে কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এবং ক্রিকেট পাগল একটা দেশের মানুষ হিসেবে যতটুকু বুঝতে পারি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে বহু সিদ্ধান্ত আসে যেগুলোর পেছনে মাঠের পারফর্মেন্সের চেয়েও অন্তরালের অনেক কিছুর যোগ থাকে। রোববার সন্ধ্যায় নেয়া অধিনায়ক পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটাও শতভাগ মাঠের পারফর্মেন্সের বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। এখানে মাঠের বাইরের ঘটনাবলিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। সেসব ঘটনাবলির একটি উপরেই বলেছি, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের কথা সংবাদ সম্মেলনে ফাঁস করে দিয়েছিলেন অধিনায়ক মুশফিক। যা পছন্দ হয়নি বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের। আবার এ অপছন্দের বিষয়টি তিনি সংবাদ সম্মেলন করেই সবাইকে জানিয়ে দেন।
কিন্তু মুশফিক কী এমন অপ্রিয় কথা বলেছিলেন যাতে এতটা চড়ে গেলেন বোর্ড সভাপতি? যতটুকু মনে পড়ে, মুশফিকের একটা কথা ছিল এ রকম- মাঠের কিছু সিদ্ধান্ত অধিনায়ককে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং রুম থেকে বলে দেওয়া হচ্ছিল। খেলার মাঠে সিদ্ধান্ত নেবেন অধিনায়ক, বাইরে থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা মানতে পারা কারো জন্যই সহজ নয়। মুশফিকও ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল। বলা হলো, তিনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। যদি তাই হয়, শৃঙ্খলা ভঙ্গের মাত্রা অনুযায়ী তাঁকে সতর্ক করা বা আর্থিক জরিমানার মতো কিছু একটা ব্যবস্থা তো নেওয়া যায়।
সেদিকে না গিয়ে শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন পুরোদস্তুর পেশাদার এবং ধারাবাহিক ক্রিকেটারের প্রতি অবিচারই করা হলো। মুশফিকুর রহিম সেই ক্রিকেটার যিনি দিনের পর দিন বিপর্যস্ত ব্যাটিংয়ের হাল ধরেছেন। বিপর্যয়ের মুখে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে বহুবার নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সবসময় সামনে থেকে টেনে নিয়েছেন দলকে। খাদের কিনার থেকেও টেনে তুলেছেন অনেকবার। তাঁকে অধিনায়কত্ব দিয়ে গোটা বাংলাদেশ নির্ভার হতে চেয়েছিল। পরিসংখ্যান বলছে, অনেকটা হয়েছেও।
মুশফিকুর রহিম ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে সেই জায়গায় এনেছেন, যেখানে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়াকেও টেস্ট ক্রিকেটে চোখ রাঙানো যায়। আগে যেখানে অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড মানেই ছিল ইনিংস পরাজয়ের লজ্জায় নত হওয়া, সেখানে এই দুই কুলীন টেস্ট খেলুড়ে দলকে অনেকটা নাকানি চুবানি খাইয়ে হারিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ ১৬ টেস্টে প্রতিপক্ষকে রুখে দিয়েছে। এর মধ্যে জয় তুলে নিয়েছে ৭টি টেস্টে, ৯টিতে ড্র। টাইগারদের এক সময়ের ড্র-এর আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে জয়ের আশায় রূপ নিয়েছে মুশফিকের হাত ধরেই।
এখন বাংলাদেশ ওয়ানডের মতো টেস্টেও খেলতে নামে জয়কে নিশানা করেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের মনে এই বিশ্বাসও জন্মেছে যে, বিশ্বের যে কাউকেই এখন আমরা হারাতে পারি। সেটা ওয়ানডেতে যেমন তেমনি টেস্টেও। এমনকি অনেকের বিশ্বাস ভারতের মতো টেস্টের এক নম্বর দলও বাংলাদেশের সঙ্গে এই ভয়ে খেলতে চায় না যে, পাছে হেরে বসে। দেশের ক্রিকেট নিয়ে ভক্তদের এই যে অতিরিক্তি আত্মবিশ্বাসের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, সেখানে নিয়ে যেতে মুশফিকুর রহিমের হাতের ব্যাট এবং গ্লাভসের যেমন অবদান আছে তেমনি তাঁর হাতের একটু উপরের দিকে থাকা ‘ক্যাপ্টেন ব্যাটনে’রও অবদান আছে। সুতরাং ব্যাটন হাতে মুশফিকের পারফর্মেন্সে ঘাটতি দেখতে চাওয়াটাই হলো একটা দুঃসাহসের বিষয়। অধিনায়ক হিসেবে তাই ব্যর্থতার কোনো অজুহাত বিসিবি তাঁর বিরুদ্ধে দেখাতে পারে না। তাহলে কেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া?
বিসিবি সভাপতি বলছেন, তাঁকে চাপ থেকে মুক্ত করে তাঁর হাত থেকে সেরা ব্যাটিংটা নিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ। তা বিসিবি সভাপতিকে কে বলেছে যে মুশফিক অধিনায়কত্বের চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছেন? তাঁর এই কথা ক’জন মানুষ বিশ্বাস করেছে? মানুষ কি জানে না, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের সময় থেকেই তিনি আভাস দিয়ে আসছিলেন মুশফিককে সরিয়ে দেবেন। তাহলে আর এত ভনিতা কেন? প্রকাশ্যে বললেই হয়, মুশফিক তাঁর কথা শোনেননি, তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মিডিয়াও বিষয়টাকে খবর করছে ‘মুশফিককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ এই শিরোনামে। কেউ বলছে না ‘অধিনায়ক পরিবর্তন করা হয়েছে’। আমাদের কথা হলো, এসব পদেও কাউকে সরিয়ে দেওয়ার দুটো কারণ থাকে, এক দুর্বল পারফর্মেন্স, দুই চরমতর কোনো শৃঙ্খলা ভঙ্গ। মাননীয় বোর্ড সভাপতি কি দয়া করে বলবেন, কোন কারণটা মুশফিককে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ হতে পারে? নাকি এটি আপনাদের ক্ষমতাবানদের খামখেয়ালির একটা খেল। আমরা যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আবেগে গা ভাসাই, দলের দুঃখে কাঁদি, সুখে হাসি, তাদের কাছে ‘অধিনায়কের খেল’টাই বেশি করে তৃষিত। অধিনায়ক নিয়ে আপনাদের এসব বিশেষ ধরনের ‘খেল’ আমরা দেখতে চাই না। আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে পূজা করি। তাঁরা আমাদের এই দীন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটান, ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দে ভাসান। তাঁদের ক্ষেত্রে প্রশ্নসাপেক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত আসুক তা আমরা চাই না। সেখানে যতটা সম্ভব ন্যায়বিচার প্রত্যাশিত এবং তা বাস্তবতার নিরীখে, নিজস্ব বা ব্যক্তিগত ইগোর তাড়নায় নয়।
লেখক- সাংবাদিক, আরটিভি