ক্রিকেট
রাজ্জাক কি পারবেন নিজেকে প্রমাণ করতে?
অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার পথিক হওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে। তিনি আগামী দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের কাছে পথ প্রদর্শক হয়ে থাকবেন। নাকি পথ ভোলা পথিক হয়ে অনেকের দলে নাম লেখাবেন সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখন তাঁর।
ক্রিকেটীয় সভ্যতায় বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে সেটাও বড় এক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর অনেকে অনেকভাবে দিতে পারেন। তবে নিছক আমজনতা হিসেবে এইটুকু বলতে পারি: এদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে মাঠ থেকে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর নজির নেই বললে চলে। আচমকা দু’একজন ঘোষনা দিয়ে বিদায় নিয়েছেন। অনেকে সেই ঘোষণা দেয়ার সুযোগও পাননি। কিংবা সুযোগ তাঁদের দেয়া হয়নি! আবার কেউ কেউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দুর্গম পথ পেরিয়ে কিছু সাফল্য পেলে সাফল্যের সেই গাছের ছায়া খুঁজতে গিয়ে বসে পড়েছেন। কখন দিন ফুরিয়ে গেছে টের পাননি! লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সাবেক হয়ে গেছেন।
বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাকের অপেক্ষা লম্বা হচ্ছিল। হতাশা বাড়ছিল। ঠিক সেরকম একটা সময় অপ্রত্যাশিত ডাক এলো বাংলাদেশ টেস্ট দলে। সেটা হয়তো সাকিবের ইনজুরির কারণে। কারণ যাই হোক জাতীয় দলে ফেরার ডাক। শ্রীলংকার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে এই ডাকে তিনি নিজেও খানিক বিস্মিত হয়েছিলেন। অবাক বিস্ময়ে সেটা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তারপর যা হলো তাতে শুধু রাজ্জাক নন, বিস্মিত প্রায় গোটা ক্রিকেট মহল। কারণ, চার বছর পর ডেকে তাঁকে মাঠে নামার সুযোগ দেয়া হলো না। বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেস থেকে স্যোসাল মিডিয়া একে লিখেছে ‘স্যাড’, ‘শকিং’ ইত্যাদি। রাজ্জাকের নিজের প্রতিক্রিয়ায়ও চেপে রাখেননি হতাশা। এই হতাশাটাও খুব অপ্রত্যাশিত নয়। অস্বাভাবিকও নয়।
চট্টগ্রাম টেস্টে প্রথম একাদশে নাম না দেখে হতাশ এবং বিষণ্ণ তিনি হতে পারেন। হতে পারেন অপমানিত। কারণ, টিম কম্বিনেশন নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচকরা যত আলোচনা করুন, টিম নিয়ে বাইরে থেকে যত কথাবার্তা হোক, যত সাজেশন যাক, স্বাভাবিক সৌজন্যতা এবং ক্রিকেটীয় ভদ্রতার পরিচয় মেলেননি তাতে। তবে চট্টগ্রাম টেস্টের পর ঢাকা টেস্টেও দলে প্রায় বছর চরেক পর ডাক পাওয়া সেই সিনিয়র ক্রিকেটারের নাম দেখে মনে হচ্ছে বাইশগজে নিজেকে প্রমাণের একটা সুযোগ হয়তো তিনি পেতে যাচ্ছেন। কারণ, স্কোয়াডে বাঁহাতি স্পিনার বলতে সেই আব্দুর রাজ্জাক একাই।
রাজ্জাকের ঢাকা টেস্ট খেলতে নামা হতে পারে দীর্ঘ সময়ের হতাশার অবসান। তিনি সফল হলে তাঁর সাফল্য হতে পারে বাংলাদেশের যাবতীয় ‘বুড়ো ক্রিকেটারদের’ সঞ্জীবণী মন্ত্র। আবার রাজ্জাক হয়ে যেতে পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে ভিন্ন পথ অবলম্বনকারী এক ক্রিকেটার। নির্বাচক আর টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতি সম্মান জানিয়ে হয়ে যেতে পারেন অন্য এক ঘরনার ক্রিকেটার। মনে মনে তিনি বলতে পারেন: সুযোগ দিয়েছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজের যোগত্যা প্রমাণের চেষ্টা করলাম, আবার নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়া অনিবার্য মনে করে মাঠ থেকেই বিদায় নিলাম। তেমনটি হলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে জন্ম হবে নতুন এক রূপকথা। এদেশের ক্রিকেট সভ্যতায় নিখাঁদ এক নতুন চেতনার ধারাও প্রবাহিত হবে। ঢাকা টেস্ট হতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেটে অন্যরকম এক চেতনার উৎপত্তিস্থল। যেখানে রাজ্জাকের বিদায় হয়ে থাকবে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স মানে জাতীয় দলে ফেরার করুণ আর্তির অবসান। রাজ্জাক অবসর নিলে তাঁর টেস্ট ক্রিকেটারের সত্ত্বাটার ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে তালা ঝুলে যাবে। বা ঝুলিয়ে দেয়া হবে। তবে এই টেস্টই হতে পারে রাজ্জাকের ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও সুযোগ না পাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ।
অবসর মানে চিরকালের জন্য নিজের টেস্ট ক্রিকেটারের সত্ত্বার মৃত্যু। ঢাকা টেস্টের পরদিন যদি রাজ্জাকের সেই পেশাদার টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে মৃত্যুর খবর শিরোণাম হয়, তাতেও ক্রিকেট মহল শোকাগ্রস্থ হবে কী না জানি না। তিনি নিজে বিষণ্ণতায় ভাষাহীন হয়ে যাবেন কি না আগাম লিখতে পারছি না। তবে দেশজ ক্রিকেটের পারিপার্শ্বিকতা দেখে এটুকু আন্দাজ করতে পারি; একটা বল আর একটা স্টাম্প হাতে নিয়ে মাঠ থেকে যদি টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় বলার সাহস দেখাতে পারেন রাজ্জাক, তাহলে তাঁর মর্যদাবোধ আর রুচি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। লড়াইটা ছেড়ে দিয়ে সরে পড়লেন রাজ্জাক, সম্ভবত সে কথা বলার সুযোগও মানুষ পাবেন না।
ক্রিকেটে একটা কথা আছে। স্পিনারদের পরিণত হওয়ার বোধ আসে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। রাজ্জাকের বয়স বেড়েছে। অনেক পরিণত বোলার তিনি এখন। বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বলের উপর নিয়ন্ত্রণও তাঁর যথেষ্ট ভাল এখনো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহসটাও বেড়েছে। সেই সাহসটা দেখানোর সুযোগ যদি তিনি পান বাইশ গজে, তাহলে আরেকটু বাড়তি সাহস দেখিয়ে ম্যাচ শেষে রাজ্জাক বলে দিতে পারেন,‘ জীবনের শেষ টেস্ট খেলে উঠলাম আমি।’
মাঠে কিছু করে দেখিয়ে মাঠের বাইরে এসে ঐ কথাটা যদি বলতে পারেন, তাহলে দেশজ ক্রিকেট মিডিয়াকে লিখতেই হবে; মধ্যবিত্ত স্পিনার হয়েও রাজার মত সরে দাঁড়ালেন রাজ্জাক। এই দেশে জায়গা পেলে কেউ স্বেচ্ছায় জায়গা ছাড়তে চান না। সেই জায়গায়ও প্রথা-বিরোধী ক্রিকেটার হয়েই থাকুন না রাজ্জাক।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।