‘নো’-র বিভ্রান্তিতে আটকে পড়েনি বাংলাদেশের জয়
উত্তেজনা-উন্মাদনা, রাগ-ক্ষোভ, উল্লাস-উচ্ছ্বাস, হতাশা-ব্যর্থতা এসবের রং মশলায় মোড়ানো এক ম্যাচ। আর এসব কিছুর যোগফল ছোট্ট একটা বাক্য-‘অসাধারণ এক ম্যাচ!’ কিন্তু সেই ম্যাচে বাংলাদেশ যা পেল সেটা অবিস্মরণীয় এক জয়। হ্যাঁ, অবিস্মরণীয়। কারণ, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এ রকম জয় আগে কবে পেয়েছে বাংলাদেশ?
শুধু জয় নয়। এই জয়ে বাংলাদেশ ইতিহাস গড়ে তিনজাতির নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে। শ্রীলংকার বিপক্ষে ‘অলিখিত সেমিফাইনাল’-এ শেষ দুই বলে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৬ রান। কিন্তু এক বল বাকি থাকতেই ফাইনালে বাংলাদেশের নাম লিখে দিলেন মাহমুদউল্লাহ। উদানাকে স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে সোজা আছড়ে ফেললেন গ্যালারিতে। দৃশ্যতঃ বলটাই আছড়ে পড়ল গ্যালারিতে। কিন্তু অদৃশ্যভাবে পুরো গ্যালারি ডুবে গেল হতাশার সমুদ্রে। অথচ কিছুক্ষণ আগে সেই গ্যালারিতে কি উত্তাল আনন্দের ঢেউ। সেখানেই নেমে এলো পিন পতন নিস্তব্ধতা। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরে সেখানেই আবার ‘নাগীনি নাচ’। সেই বিনের শব্দ আরব সাগর পেরিয়ে ভেসে আসছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কানে।স্যাটেলাইটের সৌজন্যে গোটা বিশ্ব দেখল প্রেমাদাসায় বাংলাদেশের অভিনব এক জয়োল্লাস।
এই শ্রীলংকাকে হারিয়ে আগের ম্যাচের নায়ক মুশফিকের সেই নাগীনি নাচের কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় কত কিছু ভাইরাল হলো। তারপর এই ম্যাচে লংকান ক্রিকেট কার্টুনিস্টদের নাগীনি বশীকরণের দৃশ্য হাতে গ্যালারিতে কত কিছু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেদনায় নীল হয়েই ফিরতে হয়েছে লংকানদের।
গ্যালারির সাপের কী হয়েছে সেটা বলার কোনো দরকার পড়ছে না। কিন্তু মাঠে একজন ‘শাপমুক্তি’ ঘটালেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ খুব ভালো দল নয়। এমন একটা ‘ট্যাগ’ লেগে গিয়েছিল বাংলাদেশের গায়ে। নার্ভ ঠিক রাখতে পারে না। পাওয়ার হিটার নেই। কত আলোচনা-সমালোচনা। আর সেটা বেশি হয়েছিল গত টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের সময়। ভারতের বিপক্ষে তিন বলে ৩ রান নিতে না পারা বাংলাদেশ, তিন উইকেট হেরেছিল। যার একজন ছিলেন মাহমুদউল্লাহর । এবার সেই তিনি বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। যেখানে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে সেই ভারতকেই।
শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচটা বাংলাদেশের জন্য ‘নাগনি নাচ’ ফিরিয়ে আনার ম্যাচ যেমন, ঠিক তেমনি শাপমুক্তির ম্যাচ। একই সঙ্গে ইতিহাস গড়ার ম্যাচও। এই ম্যাচ দিয়েই বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে প্রথম কোনো টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছালো। ফাইনালের দরোজায় ব্যাটের আঘাত করে দলকে ফাইনালে নিয়ে গেলেন মাহামুদউল্লাহ। আগের তিন ম্যাচে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ এই ম্যাচে হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ‘জয়ের নায়ক’। আর সেই নায়ককে আরেকজন দেখলেন লংকান ড্রেসিংরুমে বসে। তিনি বাংলাদেশের সাবেক কোচ। এক সময় যিনি হয়ে যেতেন ‘জয়ের নায়ক’। আর হারলে ‘খল নায়ক’ হয়ে যেতেন মাহমুদউল্লাহর মুশফিক-তামিম-সাকিবরা।
সময় শ্রীলংকান ভদ্রলোককে বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমের পাশের ড্রেসিংরুমে নিয়ে গেছে। অথবা তিনি নিজে গেছেন। কিন্তু এই ম্যাচের পর নিশ্চয়ই পুরোনো একটা সময় এসে উঁকি দিয়েছে মাহমুদউল্লাহর মনের জানালায়। এই কলম্বো থেকেই তাঁকে বছর খানেক আগে ‘অচল’-এর তকমা এঁটে বাংলাদেশের শততম টেস্ট থেকে ছিটকে দেওয়া হয়েছিল। সেই টেস্ট জয়ী দলের গর্বিত সদস্য হতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। এবার সেই কলম্বোতে সেই ভদ্রলোকের শ্রীলংকাকে দর্শক বানিয়ে বাংলাদেশকে ফাইনালে নিয়ে গেলেন বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে ‘বিনয়ী’ ব্যাটসম্যান। যার ব্যাট প্রায় সব সময় ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে দলের প্রয়োজনে। সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টি বা ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় বড় স্মরণীয় জয়গুলোতে অবস্মরণীয় কিছু ইনিংস কী তিনি খেলেননি!স্মৃতির সরণি দিয়ে হাঁটলে কিন্তু তাই দেখা যায়। গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা সাফল্য। সেই সাফল্য গাঁথায় অনেকে নায়ক, মহানায়ক হয়ে আছেন। কিন্তু ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি করে যিনি দলকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই মাহমুদউল্লাহ পার্শ্ব নায়ক-ই থেকে গেছেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে গত বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে খেলল বাংলাদেশ। আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টের প্রথম সেমিফাইনাল বাংলাদেশের। কিন্তু কোন অবস্থায়? কোন জায়গা থেকে সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল বাংলাদেশ। দলকে একেবারে খাদের কিনার থেকে টেনে তুলে সেমিতে নিয়েছিল যে দুটো সেঞ্চুরি, তার একটা এসেছিল মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে। বাংলাদেশ দলের এত সাফল্য গাঁথায় যার ব্যাটের অবদান, তিনি কেন বার বার পার্শ্ব নায়ক হয়ে যান সেটাও গবেষণার বিষয়। এটাও বোধহয় ইতিহাসের অন্যরকম ভাগ্য লিখন।
কিন্তু যে ম্যাচে শ্রীলংকাকে হারিয়ে নিদহাস ট্রফির ফাইনালে নাম লেখাল বাংলাদেশ, সেই ম্যাচের স্কোর শিটে এটা বল কেন ‘নো’ বল লেখা থাকবে না, সেটাও গবেষণার বিষয় হতে পারে। লংকান বোলার উদানা ব্যাটসম্যানের মাথা সমান উচ্চতায় বল তোলার পরও কেন বলটা ‘নো’ ডাকা হলো না। সেই রহস্য থেকেই যাচ্ছে। আর সেই বল নিয়ে উত্তেজনা আর ক্ষোভের আগুন তো যা দেখা গেল ক্রিকেট বিশ্বে সেটাও বিরল। আম্পায়ার নো বলের সিগনাল দিয়েও কেন মতো পল্টালেন বোঝা কঠিন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের পক্ষেও বাঁচা-মরার সেই লড়াইয়ে আম্পায়ারের ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হয়তো কঠিন ছিল। তারপরও খেলাটাতো ছিল ক্রিকেট এবং আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট। দুই দলের ক্রিকেটারদের শারীরিক ভাষায় কোথায় যেন একটু ক্রিকেট সংস্কৃতির ঘাটতি ধরা পড়ল।
কিন্তু তাঁদের দোষ দেবেন কী। আম্পায়ারের শারীরিক ভাষা যে বলছিল, ওটা ‘নো বল’। তবে অভিনন্দন জানাতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের। তারা এই ‘নো’-র বিভ্রান্তির জালে আটকে রাখেননি বাংলাদেশর জয়কে। যে জয়ের গায়ে অনায়াসে এঁটে দেওয়া যায় ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটা।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট।