নিদাহাস ট্রফি
নিশ্চয় জয় হবে টাইগারদের
একবার এক ক্রিকেট ম্যাচে শন পোলকের বলে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন রিকি পন্টিং। বল হাতে বাঁকা হাসি হেসে পোলক বললেন, ‘তুমি ক্রিকেট বল চেন তো? এটা লাল, গোলাকার, ওজন পাঁচ আউন্সের কাছাকাছি।’ পরের বলেই ছক্কা হাঁকালেন পন্টিং। পোলকের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তুমি তো জানো বলটা দেখতে কেমন। যাও, খুঁজে নিয়ে এসো!’
আমরা জানি না, শুক্রবার রাতে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে আমাদের কুল হেডেড প্লেয়ার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে সর্বশেষ বোলার উদানা শন পোলকের মতো কিছু বলেছিলেন কি না, নইলে এত চাপের মুখে দুপক্ষের পারদের উচ্চচাপে সবকিছুই যখন উত্তাল, মাহমুদউল্লাহর সুবর্ণ ব্যাট থেকে অমন ভুবন ভোলানো ছক্কা এলো কী করে? এক বল বাকি থাকতেই মাহমুদউল্লাহ যেন উদানাকে বলতে পারলেন, “যাও তুমি বাউন্ডারির বাইরের বলটা খুঁজে নিয়ে এসো, আমরা এবার সতীর্থদের নিয়ে ‘নাগিননৃত্য’ করি।”
বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে খরা চলছিল। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগের ম্যাচে রেকর্ড রান তাড়া করে অবিস্মরণীয় জয়ের পর সেই খরা কাটে। মুশফিকুর রহিম ছিলেন সে ম্যাচের মহানায়ক। পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে তীরে গিয়ে তরী ভেড়াতে পারেনি টাইগাররা। কিন্তু গত শুক্রবারের ম্যাচ সব আশাভঙ্গের বাতাবরণকে উপড়ে ফেলে দিয়ে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে নিয়ে গেছে বাংলাদেশকে। সপ্তাহখানেক ধরে নেপালে প্লেন দুর্ঘটনার শোক বইয়ে বেড়ানো বাংলাদেশের আকাশ থেকে ঘনঘোর মেঘ কাটিয়ে দিলেন সাকিব আল হাসানরা। শোক ঢাকবার অনন্য উপলক্ষটাই যেন তৈরি করলেন তাঁরা।
একটা ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে এত উত্তেজনা এর আগে দেখেছে কি বাংলাদেশ? ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়াররা কদাচিৎ ভুল করেন। গেছে বিশ্বকাপ যার বড় সাক্ষী। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচের আম্পায়ারিং ক্ষতটা বাংলাদেশিরা এখনো ভুলেনি। এই ম্যাচের শেষ ওভারও ওই দিকেই যাচ্ছিল। বাংলাদেশ হেরে গেলে আম্পায়ারের নো বল না ডাকার ওই ভুলের রেকর্ডটাই খুব বেশি করে বাজত। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং দৃঢ়তায় এক বল হাতে রেখে দলকে জিতিয়ে দেওয়ার সুখ সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।
এই ম্যাচ না জিতলে অনেক নেতিবাচকতা বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন তাড়া করে ফিরত। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অতি আবেগের ফল ম্যাচ বয়কটের সিদ্ধান্তে সাড়া দিলে মাহমুদউল্লাহদের জয়গান আমরা করতে পারতাম না। দর্শকে ঠাসা মাঠে শ্রীলংকান সমর্থকদের হাতে বাঙালি দর্শকদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও হৃদয়ে খুব বেশি করে বাজত। অতি আনন্দে ড্রেসিংরুমের দরজার কাচ ভেঙে ফেলাটা কোনো শোভনীয় কার্যাবলির মধ্যে পড়ে না যদিও, তবু সেটাও আমরা এক লহমায় উড়িয়ে দিতে পারলাম। যে ম্যাচে ক্রিকেটের এমন অভাবনীয় সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হতে পারে, সেখানকার সব অন্ধকার আমরা ভুলে থাকতে রাজি। খেলার মাঠের এমন আলোয় আমরা বারবার আলোকিত হতে চাই।
বিপদের দিনে মাহমুদউল্লাহ নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন বরাবর। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ মনে থাকবার কথা সবার? মাহমুদউল্লাহ যখন উইকেটে এলেন, ৮ রানের ২ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তাঁর ১০৩ রানের ইনিংসে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। এ ছাড়া বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১২৮ রানের অপরাজিত ইনিংস, চাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিবের সঙ্গে জোড়া সেঞ্চুরি কিংবা ২০১৬ এশিয়া কাপের টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত ইনিংস বিপদের মুখে বাংলাদেশকে জয়ের দিশা দেখিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ম্যাচে মাহমুদউল্লাহ যখন উইকেটে এলেন, তখন বাংলাদেশের অবস্থান ৩০ বলে ৫০ রানের দূরত্বে। শেষ ওভারে এই লক্ষ্যটা দাঁড়ায় ৬ বলে ১২ রানে। এমন একটা উত্তেজনাকর অবস্থায় বোলার উদানার পরপর দুবার বাউন্সার বলেও আম্পায়ার ওয়াইড বা নো বল না দেওয়ায় আম্পায়ারের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান মাহমুদউল্লাহ। যখন লক্ষ্যটা দাঁড়ায় ৪ বলে ১২-তে। ড্রেসিং থেকে নেমে আসেন অন্য খেলোয়াড়রা। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ম্যাচ বয়কটের ইশারাও দেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ বাজি রাখলেন তাঁর শীতল মস্তিষ্ককে আর আস্থা রাখলেন ইস্পাত দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের ওপর। বাকিটা নিদাহাস ইতিহাস। যার চাক্ষুস সাক্ষী প্রেমাদাসার হাজারো দর্শক এবং বিশ্বের কোটি ক্রিকেটপ্রেমী। বাঙালি এখনো সোশ্যাল মিডিয়া ভাসাচ্ছেন নাগিননৃত্যের পোজে। এই ম্যাচটা নিয়ে আজীবন গল্প করার উপলক্ষও পেল বাংলাদেশ। খাদের কিনারে গিয়েও নিজেদের সক্ষমতার ফুল ফোটাতে পারার এমন ইচ্ছাশক্তিই তো পজিটিভ ক্রিকেটের আসল ইতিহাস।
দল হারতে থাকলে দর্শক-সমর্থকরাও নিরাশ হয়ে পড়েন। নিজেদের দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। নানাভাবে খেলোয়াড় ও দল নির্বাচন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকেন। এমন একটা সময় দল জেতার ধারায় ফিরল, যখন বাংলাদেশ থেকে চলে গেছেন শ্রীলঙ্কান কোচ হাথুরুসিংহে। যার সময়কালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে। মাত্রই কিছুদিন আগে নিজেদের মাটিতে আমাদের দল টানা তিন ফরম্যাটের সিরিজ হেরেছে। সেই দলটি শ্রীলংকায় গিয়ে তাদের শক্তিশালী টি-টোয়েন্টি টিমকে পরপর দুই ম্যাচে হারিয়েই দেয়নি শুধু। নিজেদের স্বাধীনতার গৌরবের সত্তর বছরকে স্মরণ করে আয়োজিত ‘নিদাহাস’ ট্রফি থেকে খোদ শ্রীলংকাই ছিটকে পড়েছে।
আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মুশফিকুর রহিম যে ছক্কা মারতে পারেন, তা জানেন না আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন। আবার মুশফিকও ম্যাচ জেতবার পর গণমাধ্যমে বলে দেন, এবার নিশ্চয় সভাপতি বুঝবেন। খেলোয়াড়, কোচিং স্টাফ ও বোর্ড মেম্বারদের সঙ্গে এমন ঢিলেঢালা সম্পর্কের পরও আমাদের খেলোয়াড়রা তাঁদের সামর্থ্যের সবটুকু দেন। কিন্তু সকলপক্ষের এমন ‘গ্যাপ’ একটি দলকে দীর্ঘস্থায়ী ও ধারাবাহিক সাফল্যে ফিরতে মোটেও সাহায্য করতে পারে না। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে শীর্ষস্থানধারীদেরই হওয়া উচিত কোচিং স্টাফ, নির্বাচকমন্ডলি ও বোর্ড সংশ্লিষ্ট।
শ্রীলংকান ‘নিদাহাস’-এর ৭০তম বার্ষিকীতে আমাদের প্রাণান্ত অভিবাদন থাকবে। ক্রিকেট যেহেতু একটা প্রতিযোগিতামূলক খেলা এবং যেটি আইসিসি রেকর্ডেড, সেখানে জয়ের গৌরব ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আর নিঃসন্দেহে আমাদের এই গৌরবের ষোলোকলা পূর্ণ হবে ফাইনালে যদি ভারতের বিপক্ষেও এমন সহজাত খেলাটা খেলতে পারি। ভারতের লিজেন্ড ক্রিকেটার কপিল দেব বলতেন, ‘If you play good cricket, a lot of bad things get hidden!’ আমরাও ভালো ক্রিকেট খেলব, আর নিশ্চয় এতে সকল অন্ধকার দূরীভূত হবে। আজ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ জয় পেলে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে আমাদের আনন্দ।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।