স্মরণ
বিস্মৃতিই এখন আমাদের ক্রীড়া সংস্কৃতির অংশ
বাঙালির স্মৃতি দুর্বল! এ রকম চূড়ান্ত মন্তব্য করলে ভুল হবে। চরম ভুল। বাঙালির স্মৃতি সবল না দুর্বল, তা স্ক্যান করা হয় দলীয় মেশিনে! সে কারণে এই দেশে অনেক কীর্তিমান, বরেণ্য ব্যক্তিও খুব দ্রুত বিস্মৃত হয়ে যান! ব্যক্তি কেন, তাঁর অবদানকে ভুলতেও বেশি সময় লাগে না এই সমাজের। ক্রীড়ামহলে এই ভুলে যাওয়া রোগটা আরো বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে ইদানীং। ক্রীড়াঙ্গনে সমর্পিত প্রাণ ছিল যাঁদের, এমন দুজন মানুষের মৃত্যুবার্ষিকী চলে গেল কয়েক দিন আগে। তাঁদের একটু স্মরণ করারও প্রয়োজন মনে করেনি দেশজ ক্রীড়াঙ্গন!
আসলে করবে কেন? তাঁরা কি কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ক্রীড়াঙ্গনে প্রবেশ করেছিলেন? উত্তর—না। তাঁরা কি কোনো রাজনৈতিক নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরও সেই—না। তাহলে তাঁদের প্রয়াণ দিবসে তাঁদের মনে করার কী দায় পড়েছে দলদাসে পরিণত হওয়া ক্রীড়া সংগঠক, সমর্থকদের! তারও আগে প্রশ্ন কী তাঁদের পরিচয়? তাঁদের বায়োডাটায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামায়াতের প্রত্যয়নপত্র সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাবে? না। সুতরাং একজন আমিনুল হক মনি কিংবা একজন সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর মৃত্যুবার্ষিকীতে উচ্চবাচ্চ্য করার কী আছে? তাঁরা দুজনই মারা যান ২০১৫ সালের ১ জুন।
মিডিয়ার বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তাঁদের নামও জানেন না। অবশ্য তাঁদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। আমিনুল হক মনি যে ক্লাব করেছেন আমৃত্যু, সেই ক্লাবই তার মৃত্যুর পর শোক জানিয়ে যে প্রেস রিলিজটা দিয়েছিল, তাতে তাঁর নামটা পর্যন্ত ভুল লেখা হয়েছিল। আমিনুল হক মনি মোহামেডানের প্রেস রিলিজে হয়ে যান আমিনুল ইসলাম মনি। পরে অবশ্য সংশোধনী পাঠানো হয়। অথচ এই ভদ্রলোক মোহামেডানের মতো ক্লাবের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। দীর্ঘদিন সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু আমৃত্যু ওয়ারী। একসময় ক্লাবের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। কাকতলীয়ভাবে দুজনেই মারা গেছেন একই তারিখে। তার চেয়েও হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো তথ্য ছিল মৃত্যু-পরবর্তী তাঁদের নিয়ে লেখা শোক সংবাদে। আমিনুল হক মনি এবং সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু অনেক গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এই পর্যন্তই ছিল সেই সব শোকবার্তায়। সেখানে লিখতে হয়নি, মৃত্যুকালে তিনি বা তাঁরা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ অনেক গুণগ্রাহী রেখে গিয়েছেন! কারণ, আমিনুল হক মনি কিংবা সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর প্রেম ছিল খেলার সঙ্গে। ঘরবাড়ি বলতে ক্লাব, বিভিন্ন ফেডারেশন আর মাঠ! খেলা আর খেলার মাঠকে ভালোবেসে, বিয়ে করার কথাই ভাবতে পারেননি তাঁরা!
আমিনুল হক মনি শুধুই একজন মোহামেডানের সংগঠক ছিলেন? না। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক। এ দেশের ক্রিকেটের বাঁক পরিবর্তন করে আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, তার পেছনে বড় এক ভূমিকা ছিল তাঁর। নব্বই দশকের মাঝামাঝি এ দেশের মানুষের বড় এক স্বপ্নের নাম ছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে দেখা। সেই স্বপ্ন বারবার হোঁচট খেয়েছে। বাঙালির স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার সময়ও একবার আমিনুল হক মনি বিসিবির সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে ছিলেন। অবশ্য সেটা আজকের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিসিবির করপোরেট অফিসের চেয়ার নন। সেটা ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের সেই বিসিবি, যার নিজেদের কর্মচারীদের বেতন দিতে হতো কর্মকর্তাদের পকেট থেকে। দেশি-বিদেশি অতিথি এলে বাফুফে থেকে নাশতা এনে তাদের আপ্যায়ন করতে হতো! সন্ধ্যায় লোডশেডিং যেখানে নিয়মিত ছিল, আর সেই লোডশেডিংয়ের সময় সাধারণ সম্পাদককেও মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করতে হতো। ফোন বলতে একটা অ্যানালগ টেলিফোন সেট। যেটা থেকে কল করতে সাংবাদিক, কর্মকর্তাদের লাইন দিতে হতো।
স্কোর কার্ড নিয়ে বিসিবির পিয়নকে দিলকুশা-মতিঝিলের দিকে দৌড়াতে হতো ফটোকপির জন্য। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে তাঁরা স্কোর কার্ডটা ধরিয়ে দিতেন সাংবাদিকদের হাতে। যাতে ছোট করে হলেও ক্রিকেটের খবরটা পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়! আর্থিক টানাপড়েন যে বিসিবির নিয়মিত সঙ্গী ছিল, সেই বিসিবিকে চালাতে হয়েছিল আমিনুল হক মনিকে। লর্ডসে আইসিসির সভায় যোগ দিতে খরচ হয়েছিল নিজের পকেটের পয়সা। ও রকম একটা অবস্থায় লর্ডসে আইসিসির সভায় সিদ্ধান্ত হয় '৯৯-এর বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবে আইসিসি ট্রফির খেলা হবে মালয়েশিয়ায়। সেখানে ভালো মাঠ ও উইকেট নেই। তাই কৃত্রিম টার্ফের উইকেটে টুর্নামেন্ট করার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো অ্যাস্ট্রো টার্ফ নেই। সেটা বসাতে মোটা অঙ্কের টাকা দরকার। আর অ্যাস্ট্রো টার্ফে প্র্যাকটিস করতে না পারলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন আবার কফিনবন্দি হতে পারে। হতাশায় নিমজ্জিত হতে গোটা দেশ।
লর্ডসে সভা শেষ করে নার্সারি গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে বিসিবির সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মনি আগাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে গোটা দুয়েক অ্যাস্ট্রো টার্ফ বসানোর অর্থ তিনি কোথায় পাবেন! নিজের সেই দুশ্চিন্তার কথা তাঁর সফরসঙ্গী বিসিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট রাইস উদ্দিন আহমেদকে বলে বসলেন। বছর দেড়েক আগে রাইস উদ্দিন আহমেদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন সেই কথা। 'রাইস ভাই, অ্যাস্ট্রো টার্ফ না বসাতে পারলে আমাদের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে আবারও। অন্তত দুটো মৌসুম যদি আমাদের ক্রিকেটাররা ট্রার্ফে খেলতে পারে, তাহলে আগামী বিশ্বকাপে আমরা খেলব। নান্নু-আকরাম-বুলবুল ওরা অনেক ভালো ব্যাটসম্যান। কিন্তু আমরা যদি ওদের সুযোগ করে দিতে না পারি, তাহলে আইসিসির এইসব মিটিংয়ে এসে আমাদের কী লাভ!' হতাশ-চিন্তাগ্রস্ত আমিনুল হক মনির প্রশ্ন। তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন রাইসউদ্দিন। বলেছিলেন, 'চিন্তা করো না। চলো লন্ডনে টার্ফের অর্ডার দিয়ে যাই। টাকার একটা জোগাড় করা যাবে দেশে ফিরে। তাঁরা ফিরলেন। অ্যাস্ট্রো টার্ফও এলো। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা দুটো মৌসুম সেই টার্ফে প্র্যাকটিস করা একমাত্র দল হিসেবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল। পরেরটুকু ইতিহাস। আর সেই ইতিহাস সবার জানা। শুধু অজানা থেকে গেল সেই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যে সিদ্ধান্ত, সেটা কার মস্তিষ্কজাত ছিল। ভদ্রলোকের নাম—আমিনুল হক মনি। সে সময়ে বিসিবির সাধারণ সম্পাদক। পরে তিনি বিসিবির পরিচালকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছিলেন প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের নিয়ে।
ভদ্রলোক শুধু ক্রিকেটের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না। টেবিল টেনিস ফেডারেশনেরও সঙ্গেও ছিলেন। নিজে টেবিল টেনিস খেলতেন। ক্রিকেটও খেলেছেন। বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্টদের পক্ষে-বিপক্ষে পঞ্চাশ পেরিয়ে আসা বয়সে প্রদর্শনী ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে খ্যাতি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিয়েছিলেন। আপদমস্তক ভদ্রলোক লোভনীয়-সম্মানীয় সেই পেশাকেও ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনে। জীবনের ওপারে এখন তাঁর কোনো অনুশোচনা হচ্ছে কি না জানি না। তবে এপারে বসে খুব গর্ব করে বলতে পারি—এ রকম একজন ভদ্রলোককে ক্রিকেট বোর্ডে দেখেছি খুব কাছ থেকে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। বিসিবি অফিস থেকে আবার রাতের আড্ডায় যোগ দিয়েছেন তাঁর প্রিয় মোহামেডান ক্লাবে। খুব স্বল্পভাষী ছিলেন। উচ্চ লয়ে তাঁর মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হতে শুনিনি। তিনি ছিলেন, আমাদের সেই মনি ভাই। মনি ভাই, আপনার ক্রিকেট বোর্ড কেন আজ আপনাকে মনে রাখবে! কেন আপনাকে স্মরণ করবে! আপনি ছিলেন পকেটের পয়সা খরচ করে বিশ্বের দরিদ্র এবং ঋণগ্রস্ত এক বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক। যার মস্তিষ্কজাত একটা সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলার পথটা মসৃণ করে ফেলেছিল। যে কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আজ বিশ্বের অন্যতম ধনী বোর্ড! কেউ মনে রাখুক বা নাই রাখুক, এ দেশের ক্রিকেটের গৌরবান্বিত বাঁক পরিবর্তনের সময় আপনিও ছিলেন এক অংশীজন।
সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু। আমাদের বাচ্চু ভাই। ক্রীড়াঙ্গনের বাচ্চু ভাই। ওয়ারী ক্লাবের বাচ্চু ভাই। ভলিবল থেকে ফুটবলের পরীক্ষিত এক সংগঠক। বাফুফের বিভিন্ন পদে ছিলেন। যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন লম্বা সময়। বাংলাদেশে নারী ফুটবল প্রচলনের অন্যতম সংগঠক তিনি। দেশের ফুটবল অঙ্গন ছাড়িয়ে নিজেকে আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনেও নিয়ে গিয়েছিলেন সংগঠক হিসেবে। সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশেনর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ ফুটবলে অনেককে ফিফা, এএফসির দরজা চিনিয়েছেন। লাখ লাখ টাকা বেতন দিয়ে আজ বাফুফে যাদের পুষছে, পেশাদার হিসেবে তারা যে কাজ করে, সেই কাজই তিনি করেছেন দিন-রাত বাফুফেতে বসে। সাবেক তারকা ফুটবলার বর্তমানে বাফুফের সহসভাপতি অসুস্থ বাদল রায় দিন কয়েক আগে বলেছিলেন, ‘বাচ্চু ভাই আর আমি ছিলাম বাফুফের যুগ্ম সম্পাদক। আমি অনেক কিছু বুঝতাম না। বাচ্চু ভাই আমাকে নিজের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন।’ নব্বইয় দশকের মাঝামাঝি বাচ্চু ভাইয়ের কাছে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা আবদার নিয়ে হাজির হতাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তার অফিসে। 'বাচ্চু ভাই, লেখাটা দিন।’ ‘দিচ্ছি’ বলেই কাগজ নিয়ে বসে পড়তেন। আর তাঁর পিয়নকে বলতেন, এই দাদাকে মুড়ি-চানাচুর দে। ঘণ্টা দুয়েক পর অসাধারণ একটা ব্যঙ্গাত্মক খেলা হাতে ধরিয়ে দিতেন। তাঁর সম্মানী নিয়ে গেলে নিজের পিয়নকে বলতেন, 'টাকাটা তুই রাখ। সইটা আমি করে দিচ্ছি।' বাচ্চু ভাই বয়সে আমার অনেক বড়। তবু দেখা হলেই বলতেন দাদা কেমন আছেন। বাসার সবাই ভালো?'
দেখা হলেই বলতাম, ‘বাচ্চু ভাই স্টেডিয়ামপাড়ায় আপনিই একমাত্র লোক, যিনি দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করেন বাসার সবার কথা।' সত্যি, স্টেডিয়ামে এখনো মাঝেমধ্যে যাই। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয়। কিন্তু ওভাবে কেউ জিজ্ঞাসা করেন না, 'বাসার সবাই ভালো?' বাচ্চু ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। কিন্তু আপনার জন্য খুব ভালো খবর দিতে পারছি না। আপনার ফুটবল যে মোটেও ভালো নেই। আপনি একবার ফিফার র্যাংকিং দেখিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা একশ বারো নম্বরে আছি। আমাদের লক্ষ্য একশর নিচে র্যাংকিংটা নিচে নামিয়ে আনা।' আপনার সেই বাংলাদেশ এখন খুব দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে ফিফার র্যাংকিংয়ের দুশোর দিকে! কতই বা আর বাকি! আপাতত আমরা আছি ১৯৭-এ।
সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু প্রায় বিস্মৃত এক নাম এখন ফুটবলে। কিন্তু দেশজ ফুটবলই যে দিনে দিনে মুছে যাচ্ছে বাঙালির মানস থেকে! আর আমিনুল হক মনি? আপনার ক্রিকেট আছে। বেশ ভালোভাবেই আছে। নেই শুধু শুধু আপনাদের মনে করার কোনো সংস্কৃতি!
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।