ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা,সম্ভাবনা কতটুকু?
বাংলাদেশে ফুটবল বিশ্বকাপ মানে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এই দুই দলের একটিকে সমর্থন করেন;ভালোবাসেন। জার্মানি, স্পেন, ইতালি, ইংল্যান্ডের সমর্থকও আছেন। কেউ আবার ফুটবলেও ধর্মীয় বিষয়টি বিবেচনায় আনেন। সমর্থন করেন ইরান, মিশর, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া।
অনেকে বলেন, বাংলাদেশে পতাকার বিশ্বকাপ। দৃশ্যপটও তাই। পতাকা ফেরি করে ফেরা মানুষগুলোকে দেখা যায় স্টেডিয়ামের আশপাশে, গলি, পাড়া মহল্লায় সবখানে। সবচেয়ে বেশি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকা। নবাগত দলেরও পতাকা থাকে। যেমন ২০০২ সালের সেনেগাল, পরের বিশ্বকাপের ঘানা, মরক্কো, ক্রোয়েশিয়া কত কত দল। অনেকে পতাকার মধ্যে সৌন্দর্য খোঁজেন। ছাদে আর বারান্দায় প্রিয় দলের অসংখ্য পতাকা সাজান। সবচেয়ে বড় পতাকাটা ওড়ান মাঝখানে। এলাকায় এলাকায় ছেলেপুলের কথার বাজি লাগে কার পতাকা কত বড়!
আবার আর্জেন্টিনার মেসি না ব্রাজিলের নেইমার? এমন ভাবনা যুক্তি পাল্টা যুক্তি নিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডায় আর ক্যাম্পাসের সবুজ গালিচায় হাজির হয় সব বয়সের মানুষ। কি শিশু যুবা বৃদ্ধ সবাই যেন বুঁদ হয়ে থাকেন বিশ্বকাপ উত্তেজনায়।
বাবা মা শিশুদের নিজেদের পছন্দের দলের জার্সি কিনে দেন। প্রোফাইলের ছবি বদলান। ফেসবুকেও ‘ট্রল’ হয় নুতন নতুন এডিট করা অনেক ছবি। ফেসবুকে জার্সি বেচাকেনা চলে। অস্বচ্ছল মানুষদের জন্য মেসি নেইমারের ছবি দিয়ে ফুটপাতে বায়তুল মোকাররমের দুপাশেই পসরা বসে।
কিন্তু যে দলগুলো নিয়ে এত মাতামাতি, তাদের সম্ভবনা কতটুকু? বিশ্বকাপে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা আছে দুই মেরুতে। আর্জেন্টিনা গ্রুপ 'ই' তে আর ব্রাজিল গ্রুপ 'ডি'তে। যার ফলে শুধু ফাইনাল ছাড়া দুইদলের দেখা হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ।কারণ শেষ ষোলেতে গ্রুপ- ‘ডি’র দুই দল মুখোমুখি হবে গ্রুপ-’সি’র দুই দলের। তুলনামূলক সহজ গ্রুপেই পড়েছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ‘ই’ গ্রুপে ব্রাজিলের সঙ্গে আছে সুইজারল্যান্ড, কোস্টারিকা ও সার্বিয়া। গ্রুপ ‘ডি’তে আর্জেন্টিনার সঙ্গী ক্রোয়েশিয়া, আইসল্যান্ড ও নাইজেরিয়া। আর্জেন্টিনার গ্রুপটা একটু কঠিন হলেও গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে পড়ার মতো মোটেও নয়।
কোস্টারিকা বাছাইপর্বে হন্ডুরাসের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপে ওঠে। দল হিসেবে কোস্টারিকাকে একেবারে ফেলা দেওয়ার মতো নয়। গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েছে দলটি। ব্রায়ান রুইজ, মারকো উরেনা, সেলসো বরগেসরা ই গ্রুপের চ্যালেঞ্জ নিতে পূর্ণ প্রস্তুত।গতবার তারা সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও ইংল্যান্ডকে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় করে দেয়।
নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে সেমিফাইনাল খেলেছিল সার্বিয়া। এরপর ১৯৬২ সালেও সেমিফাইনাল খেলেছে তারা।আলেক্সান্ডার মিত্রোভিচ আর ব্র্যানিস্লাভ ইভানভিচরা তো আছেনই আরও আছেন লিভারপুলের তরুণ মিডফিল্ডার মারকো গ্রুজিচ। মাত্র কয়েক মাস আগে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে জিতেছে সুইজারল্যান্ড। আলপিনো পর্বতের মেসি খ্যাতি পেয়েছেন জেরডেন শাকিরি। সুইস এই তারকার আরও একটি নাম আছে। দি ম্যাজিক ডুয়ার্ফ। বামন জাদুকর।
তিতের দল টানা ম্যাচ জিতে চলেছে। গত জুনে আর্জেন্টিনার কাছে পরাজয়ের পর সাত ম্যাচ অপরাজিত ব্রাজিল। দলে নেইমার ছাড়াও তারকাখ্যাতি পাওয়া জেসাস, পলিনহো, কটিনহো, আলভেসরা আছেন। দুর্দান্ত এই দলটা গ্রুপ পর্বে তো বটেই, বিশ্বকাপেরই ফেবারিট। রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিল ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। এমন সম্ভাবনাই জাগিয়ে তুলেছেন নেইমাররা।তবে এবার ইনজুরির কারনে দলে নেই দুর্দান্ত ডিফেন্ডার আলভেজ।
বিশ্বকাপই খেলতে পারবে না এমন শঙ্কার মাঝে শেষ দিকে বাছাই পর্বের বাঁধা উৎরায় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ এবার আইসল্যান্ড। রাশিয়ার আসর দিয়েই ১০ লাখের কম বসতির দেশটির বিশ্বকাপের শুরু। গত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ থেকেই দুর্দান্ত খেলার জন্য আইসল্যান্ড অনেকের চোখেই ‘পচা শামুক।’ এ কারণে তাঁদের বিপক্ষে বাকি তিন দলের পা কাটার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
নাইজেরিয়া এর আগেও বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে কম ভোগায়নি আর্জেন্টিনাকে। আফ্রিকার সুপার ঈগল খ্যাত দলটিতে আছে তারকা খ্যাতি পাওয়া বেশ কিছু তারকা। ২০১৮ বিশ্বকাপে সবচেয়ে তরুণ দলের তকমা নিয়েই মাঠে নামছে আফ্রিকান দল নাইজেরিয়া দলের অধিনায়ক মিকেল অবশ্য দল নিয়ে সন্তুষ্ট। সবার বয়সের গড় পঁচিশের নিচে।
ক্রোয়েশিয়া প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের বিপক্ষে খেলে ২০০৫ সালে। ওই ম্যাচে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের প্রায় ধরেই ফেলেছিল ক্রোয়াটরা। দল হিসেবে এবারও আর্জেন্টিনার জন্য শক্তিশালী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তারা। তবে বিশ্বকাপের প্রাথমিক বাঁধা টপকানোর ইতিহাস ঘেটে আর্জেন্টিনার তেমন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কম বলে মনে করেন বোদ্ধারা।
শক্তির বিচারে ফ্রান্স গ্রুপ 'সি'র চ্যাম্পিয়ন হলে রানারআপ পেরু অথবা ডেনমার্কের। সে হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডের বাধা অনায়াসেই পার হতে পারে আর্জেন্টিনা।আর চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ব্রাজিল মুখোমুখী হতে পারে মেক্সিকো অথবা সুইডেনের। দলের ছন্দ থাকলে এমন বাঁধায় হোচট খেতে হয়তো হবেনা ব্রাজিলের।
এরপর আর্জেন্টিনার সাম্ভাব্য বিপক্ষ ফ্রান্স দল হিসেবে বিপদজনক হলেও মেসি ও তার দলের ভালো খেলার ওপর সেমিফাইনাল নির্ভর করছে। আর ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হতে পারে জার্মানি। দল হিসেবে খুবই দুরন্ত। পাওয়ার ফুটবলের জনক। গেল বারের দুঃস্বপ ভুলে ব্রাজিলকে ২০০২ সালের ফাইনালের প্রতিপক্ষের মতো খেলতে হবে। জয় তাহলে আসতে পারে।
তবে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলকে কোয়ার্টারের বাঁধা দূর করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মানছেন বোদ্ধারা। কারণ আর্জেন্টিনা গত বছরে ফাইনালে গেলেও কয়েকটি বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে এসেই থমকে দাঁড়াতে হয়েছে দল দুটিকে।
দল হিসেবে এবার ইতালি বিশ্বকাপেই উঠতে পারেনি। গতবারের ওয়েলস,চেক প্রজাতন্ত্র এবার বিশ্বকাপে নেই। স্পেনের অবস্থা গেলবারে খুব ভালো ছিল না। ওই হিসেবে বরাবরের মতো জার্মানির দুরন্ত ফুটবলের কাছে ল্যাতিন দলগুলো ধরাশায়ী হয়েছে বার বার। এবার সে বাধা দূর করতে নিশ্চয় চাইবে ব্রাজিল। আর আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ফুটবল দেবতা লিওনেল মেসির সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ স্বরণীয় করার চিন্তা আছে দলটির।
তবে গোল খেয়ে ব্রাজিলের ছন্দ না হারানো এবং আর্জেন্টিনার ডিফেন্স শক্তিশালী করার মধ্যে সে টোটকা খুজছেন নামী দামি ফুটবলাররা।
লেখক: নিয়ামুল আযীয সাদেক, সাংবাদিক