শিরোপায় বঞ্চনার জবাব নারী ক্রিকেটারদের
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর যেন আমাদের ক্রিকেটের উত্থানভূমি। ২১ বছর আগে এই কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠ থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বপ্নযুগের। ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমেই বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। সে ধারাবাহিকতায় এসেছে টেস্ট স্ট্যাটাস। তারপর নানা উত্থান-পতনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। নানান লজ্জা-গ্লানির ইতিহাস যেমন আাছে, তেমনি আছে গোটা জাতিকে গৌরবে ভাসানোর অনেক গল্পও। গত ২১ বছরে বাংলাদেশ সব ক্রিকেট পরাশক্তিকে হারিয়েছে। বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন এক আতঙ্কের নাম। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের শোকেসে কোনো ট্রফি ছিল না। সেই বন্ধ্যত্ব ঘুচল সেই কুয়ালালামপুর থেকেই। নারী ক্রিকেটাররা নারী এশিয়া কাপের প্রথম টানা ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা এটি। ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালের ফাইনালও ভারে সমীকরণ ছিল ৬ বলে ৯ রান। মাহমুদুল্লাহ-শাহাদাত সে সমীকরণ মেলাতে পারেননি। আবারও এশিয়া কাপের ফাইনালে ৬ বলে ৯ রানের হিসাব। এবার কড়ায়-গণ্ডায় মিলিয়ে দিলেন জাহানারা। শ্রীলঙ্কার কাছে হার দিয়ে যে টুর্নামেন্ট শুরু, চার দিনের মধ্যে পাকিস্তানকে একবার, ভারতকে দুবার হারিয়ে সেই বাংলাদেশ এখন চ্যাম্পিয়ন।
আফগানিস্তানের কাছে সিরিজ হেরে পুরুষ ক্রিকেট দল যখন সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ, তখন সেই কাঁটা সরিয়ে সাফল্যের ফুল ফোটাল মেয়েরা। এই সাফল্যে মেয়েরা যেন তাদের প্রতি অবহেলা-উপেক্ষার জবাব দিল দারুণভাবে। মেয়েরা এখন অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছে। দাবি উঠেছে, তাদের বাড়ি, গাড়ি, অর্থ পুরস্কারের। জানি, কিছু না কিছু পুরস্কার তারা পাবে। কিন্তু তাতে কি প্রশমিত হবে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ক্ষত? পুরুষ ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের মানুষের চোখের মণি। অর্থে-বিত্তে, জনপ্রিয়তায় তারা দূর আকাশের তারা। প্রচারের সব আলো সব সময় তাদের খুঁজে ফেরে। কিন্তু আলোর নিচেই গভীর অন্ধকারের মতো নারী ক্রিকেটাররা। তাদের কেউ চেনে না, কোনো প্রচারণা নেই, স্পন্সর নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে নারীদের ম্যাচ ফি মাত্র ৬০০ টাকা। পুরুষ ক্রিকেটারদের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন দুই লাখ টাকা। আর নারী ক্রিকেটারদের সর্বোচ্চ বেতন ৩০ হাজার টাকা। শুধু ক্রিকেটে নয়, বাংলাদেশে প্রায় সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এ বৈষম্য রয়েছে। নারীরা সমান কাজ করেও পারিশ্রমিক পুরুষদের চেয়ে কম পান। তবে ক্রিকেটের মতো এমন আকাশ-পাতাল বৈষম্য আর কোথাও নেই। কুয়ালালামপুরের কিনরারা একাডেমিও ভালো মাঠে সেই বঞ্চনারই কি জবাব দিল আমাদের মেয়েরা? শিরোপা জয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধিনায়ক সালমা খাতুন বলেছিলেন, আমাদের হারানোর কিছু ছিল না। আসলেই হারানোর কিছু ছিল না বলেই আমরা পেয়েছি অনেক কিছু। নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে, নিজেদের অর্জন দিয়ে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তাদের প্রাপ্য। এবার যদি আমাদের কর্তাদের চোখ খোলে। আমাদের ক্রিকেটের দুয়োরানিদের এবার একটু সম্মান দেওয়ার পালা।
আমরা সাফল্য চাই, আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি। একটু সাফল্য পেলেই আমরা ক্রিকেটারদের মাথায় তুলে নাচি। আবার ব্যর্থতা সইতে পারি না। আফগানিস্তানের কাছে বাজেভাবে সিরিজ হারের পর সবার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, দেশের ক্রিকেট বুঝি রসাতলে গেছে। কেউ বুঝতেই চান না, সব ম্যাচে জেতা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। একসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাফল্যের সূর্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্ত যেত না। সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের নিচে। অস্ট্রেলিয়াও তো আর অপরাজেয় নয়। তাই বাংলাদেশ সব ম্যাচ জিতবে, এমনটা যাঁরা ভাবেন, তাঁরা হয় ক্রিকেট বোঝেন না, নয় মানবিক নন। দুদিন আগেই যে সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরা ছিল চোখের মণি, এখন তাঁরাই জাতীয় ভিলেন। মেয়েদের সাফল্যের পর একটা অদ্ভুত বিষয় শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ছেলেদের সুবিধাগুলো মেয়েদের দিয়ে দেওয়া হোক, কেউ বলছেন ছেলেদের দলে মেয়েদেরও সুযোগ দেওয়া হোক, কেউ বলছেন ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের খেলার আয়োজন করা হোক। মোটকথা ক্রিকেটে মেয়েদের ছেলেদের প্রতিদ্বন্দ্বী বানোনোর একটা ষড়যন্ত্র চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অথচ মাশরাফি-তামিম-মুশফিকরা সালমাদের জয়ের মুহূর্তে সাধারণ সমর্থকদের মতোই পাগলের মতো উল্লাস করেছেন। আপনি যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশেকে ভালোবাসেন, তাহলে ক্রিকেটের পাশে থাকতে হবে; ছেলেদের, মেয়েদের; সবার পাশে থাকতে হবে। মাশরাফি-সাকিবদের দেখে অনুপ্রেরণা নিয়েই এত বঞ্চনার পরও ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে গেছেন সালমা-রুমানারা। ছেলেরা-মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে নেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। সব অর্জনই বাংলাদেশের।
তবে নারীরা যেন বঞ্চিত না হয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে। আমি বলছি না, নারী-পুরুষের সমান অধিকার দিতে হবে বা নারীদের বেতন পুরুষদের সমান করে দিতে হবে। আমি চাই ন্যায্য অধিকার। যাঁর যা প্রাপ্য, তাঁকে সেটা দিতেই হবে। স্পন্সর না থাকলে ক্রিকেট বোর্ডকে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে। তবু নারীরা কুয়ালালামপুরে সম্ভাবনার যে ফুল ফুটিয়েছে, তা যেন অকালে ঝরে না যায়, যেন পূর্ণ সৌরভ নিয়ে বিকশিত হয়।
লেখক: সাংবাদিক