ক্রিকেট
বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের জয়গান শুরু
বাংলাদেশের এশিয়া কাপ জয়। দারুণ তৃপ্তির এবং স্বস্তির এক খবর। কিন্তু না। খবরটা লিখতে হয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের এশিয়া কাপ জয়! হ্যাঁ, নারীদের এশিয়া কাপ। নারী শব্দটা তো লিখতেই হবে। সেটা ভদ্রতা বিসর্জন দিয়ে হলেও। এবং তাতে আপনার যতই অস্বস্তি লাগুক। তারপরও এই জয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। কারণ, বাংলাদেশ এর আগে কখনো এশিয়া কাপ জিততে পারেনি। কুয়ালালামপুর থেকেই বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটারদের জয়যাত্রা শুরু হলো। সেখানেই গীত হলো বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটের জয়গান।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক পরিবর্তন হয়েছিল একুশ বছর আগে। বাংলাদেশ সেদিন আইসিসি ট্রফি জিতেছিল। বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ করেছিল। তা নিয়ে অবশ্য বাঙালি আবেগের বাঁধভাঙা স্রোতে ভেসেছিল। এবার সেই কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা জিতলেন এশিয়া কাপ, যা এখনো পুরুষ ক্রিকেটাররা জিততে পারেননি। এই পারা-না পারার সমীকরণ মেলাতে গিয়ে কাউকে ছোট-বড় করার দরকার নেই। তবু একটা কথা লিখতে হচ্ছে, এ রকম একটা ট্রফি যদি বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটারদের হাত ধরে আসত, তাতে গোটা দেশ আবার ভাসত আবেগে। মেতে উঠত জয়োল্লাসে। কিন্তু নারী ক্রিকেটারদের এত বড় সাফল্যেও বাঙালি কেন যেন একটু আবেগের খরায় ভুগল! এটা বাঙালির জীবনের একটা নেতিবাচক দিকও বটে। কিন্তু ইতি-নেতি, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, জীবনের অঙ্গ। তা ছাড়া শুধু বিজয়োল্লাসেই জয় সূচিত হয় না।
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ জিতে যে জয় অর্জন করেছে, তাতে কি দেশজ নারী ক্রিকেট দিগন্তে শুধু আলো আর আলোই দেখছি? সেখানে কি শুধু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি রয়েছে? তেমনটা ভাবলে ভুল হবে। সেখানে অন্ধকারও আসতে পারে। মেঘে ঢেকে যেতে পারে আপাত উজ্জ্বল দিগন্ত। হ্যাঁ, সাফল্যের এই উজ্জ্বল রেখাকে প্রেক্ষাপটে রেখেও তেমন আশঙ্কা মনে জাগে। তার কারণ, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা। সালমা-জাহানারা-রুমানারা এশিয়া কাপ জিতেছেন। বিসিবি তাদের বেতন বাড়িয়েছে। বোনাস ঘোষণা করেছে। সবই সদার্থক। শুভ উদ্যোগ। কিন্তু এটা তো সেই বাংলাদেশ, যেখানে বছর কয়েক আগে রাজপথে মিছিল বেরিয়েছে, মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে! কেন ক্রিকেট মাঠে নামবে! অথচ সেই মেয়েদের হাত ধরেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন মাঝেমধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তারপরও কেন শঙ্কা? হ্যাঁ, শঙ্কা জাগে। কারণ জীবনে ঝঞ্ঝা থাকে, যা আচমকা আলোকে ঢেকে দিকে চায়। তাই আপাত সাফল্যের আলোকিত দিগন্তে কালো মেঘ আসতে কতক্ষণ!
কেন শঙ্কা? এই প্রশ্নের উত্তর দুটো অংশে বিভক্ত। একটা আমাদের মানসিকতায় নিহিত। নারীকে আমরা এখনো মানুষ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নই। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্যও থেকে যাচ্ছে নারী ক্রিকেটারদের এশিয়া কাপ জয় শব্দগুলোর মোড়কে মোড়ানো। পুরুষ ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপের ফাইনালে হেরেছিল, তা নিয়ে কত অশ্রুপাত! কত আলোচনা! কত দুঃখ-বেদনা-হতাশার কাব্য! অথচ নারীদের, সেই সাফল্যের গল্পটা মনে হবে ছোট সোনামণিরা কিছু একটা লিখল!
বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেস হয়তো এক ধরনের মনঃকষ্টে ভুগছে কিংবা আগামীতে ভুগবে। ইশ, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্যের সাক্ষী হতে পারলেন না তাঁরা। সেই জয়ের কথা কেউ প্রেসবক্স থেকে লিখতে পারলেন না! ভারতের মতো দলের বিপক্ষে ফাইনাল। এবং শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল। সে রকম একটা ম্যাচে স্নায়ু ঠিক রেখে ম্যাচটা বের করা কঠিন ছিল। সেই কঠিন কাজটা যাঁরা করলেন, তাঁরা অবশ্য সমাজের কঠিন এক দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। এরা প্রত্যেকেই উঠে এসেছেন বাংলাদেশের কোনো না কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকে। সেখানে না ছিল ক্রিকেট অবকাঠামো। না ছিল সামাজিক নিরাপত্তা। ওদের সঙ্গী ছিল শুধুই অদম্য ইচ্ছাশক্তি। কিছু একটা করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। এবং সেটা তাঁরা করে দেখালেন। যার পুরস্কার পেলেন দুই কোটি টাকার টিম বোনাস। বাড়তি কিছু মাসিক বেতন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের এই ক্রিকেটীয় সাফল্য কি ভেঙে দিতে পারবে সামাজিক সব প্রতিবন্ধকতার দেয়াল? বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে এখনো নানা প্রতিকূলতা আছে। সেগুলোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলা খুব সহজসাধ্য কোনো কাজ নয়।
শঙ্কার আর একটা কারণ, সালমা-জাহানার-রুমানাদের হাত থেকে সাফল্যের এই ব্যাটন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত কি তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। সেটা না পারলে বলাবলি শুরু হয়ে যাবে, আরে এশিয়া কাপ জয় তো ছিল একটা ফ্লুক! কারণ, বাঙালির ভুলতে বেশিক্ষণ লাগে না! যে ভারত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে, যারা ছয় ছয়বারের এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন, তাদের একই টুর্নামেন্টে দু-দুবার হারানো খুব সহজ কাজ নয়। সেটা ফ্লুক হতে পারে না। আর সেই কথাটা আরো জোরালো গলায় বলা যায়, কারণ একই টুর্নামেন্টে পাকিস্তানকেও উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের এই সাফল্যকে অসাধারণ, অসামান্য বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না।
এ রকম অসামান্য সাফল্যের রূপকার যাঁরা, তাঁরা পরের একটা টুর্নামেন্ট হারলেই যেন গেল গেল রব না ওঠে। এদের দিয়ে হবে না কোরাস গাইতে শুরু না করি আমরা। শুধু একটা কথা মনে রাখলেই চলবে, ওরা হয় সফল হবে, না হয় ভুল থেকে শিখবে। সেই কথাটাই কিন্তু এশিয়া কাপে সালমা-জাহানারারা মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রথম ম্যাচে শ্রীলংকার কাছে হেরেছিলেন তাঁরা। তখন কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি, এই দলটাই ফাইনাল খেলবে। ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে কাপ জিতবে। মানুষ ব্যর্থ হতে পারে না। হয় সফল হবে। না হয় শিখবে। এই তত্ত্বের দৃষ্টান্ত রাখলেন সালমা খাতুনরা এশিয়া কাপে।
ক্রিকেট জীবনকে অনেক শিক্ষাই দেয়। জীবন সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে কতটা প্রস্তুত থাকে, সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের এশিয়া কাপ জয়, ক্রিকেট কর্তা থেকে সমাজকে একটা বার্তা দিয়ে গেল : একবার-দুবার ব্যর্থ হলেই তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে নেই। আবার একটু সাফল্যেই মুগ্ধ হয়ে দুচোখ ভরে শুধু তার দিকে তাকিয়েও থাকতে নেই। দুহাত উজাড় করেও দিতে নেই। বরং সাফল্যের দিকে ছুটতে গিয়ে যাঁরা প্রতিদিন প্রতিকূলতার উজান বাইছে, তাঁদের দিকেই খানিকটা হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।