ফুটবল
মেসির হাতেই উঠুক বিশ্বকাপ
ছেলেবেলা থেকেই আমি ব্রাজিল ফুটবলের সমর্থক। আমার দ্বিতীয় পছন্দ আর্জেন্টিনা। কারো কারো কাছে এই সমীকরণটা অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে এটাই সত্যি, এটাই বাস্তবতা। আমি আসলে ফুটবলে ল্যাতিন ঘরানার সমর্থক। আর এই ঘরানার ফুটবলটা মাঠে সবচেয়ে শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলে ব্রাজিল। ব্রাজিল যখন তাদের নিজেদের খেলাটা খেলে, মনে হয় মাঠে কিছু হলুদ প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। তাই ব্রাজিলের প্রতি পক্ষপাতটা একটু বেশি। সূর্যের পাশে যেমন চাঁদ, ব্রাজিলের পাশে তেমন আর্জেন্টিনা। বিশ্ব ফুটবলে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সামর্থ্য আছে কেবল এই দুই ল্যাতিন দলেরই। আমি জানি আঞ্চলিক ফুটবল রাজনীতিতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা প্রবল প্রতিপক্ষ। কিন্তু তাতে আমার ভালোবাসতে কোনো অসুবিধা হয় না।
আর্জেন্টিনার মতো ল্যাতিন দল উরুগুয়েও দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু উরুগুয়ের সেই দিন আর নেই। আমার আরেক প্রিয় দল চিলি এবার বিশ্বকাপেই নেই। গত বিশ্বকাপে কলাম্বিয়া, আরো নির্দিষ্ট করে বললে হামেস রদ্রিগেজ আমার হৃদয় হরণ করেছিল। তবু আমার ফুটবল রোমান্টিকতা ব্রাজিলকে ঘিরেই। আমার বিশ্বকাপ ফলো শুরু ১৯৮২ বিশ্বকাপ থেকে। তার আগে বইয়ে-পত্রিকায় পেলের বিশ্বজয়ের গল্প পড়েছি। তবে ১৯৮২ সালের ব্রাজিল শিরোপা না জিতলেও বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছিল। জিকো-সক্রেটিসের সেই দলকে বলা হয়, বিশ্বকাপ না জেতা সেরা স্কোয়াড। ৭৪ সালে যেমন হল্যান্ড শিরোপা জিততে পারেনি, কিন্তু মানুষের হৃদয় রাঙিয়েছিল। বলছিলাম ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবলের কথা। এই সৌন্দর্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে ব্রাজিল ২৪ বছর শিরোপা বঞ্চিত ছিল। তাই সাফল্যের দেখা পেতে সৌন্দর্য স্যাক্রিফাইস করল ব্রাজিল। তাতেই দেখা মিলল শিরোপার। কিন্তু ভোটাভুটি হলে বিশ্বজুড়ে ব্রাজিল সমর্থকরা ৯৪ সালের বিশ্বজয়ী ব্রাজিলের চেয়ে ৮২ সালের ব্রাজিল দলকে বেশি ভোট দেবে।
বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে বদলে দেয় একেবারেই। এক মাসের জন্য বাংলাদেশের সবকিছুই ফুটবলময় হয়ে যায়। বাকি সময়টা ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বাংলাদেশের মানুষের রক্তের ভেতরে যে ফুটবল নাচন তোলে, বিশ্বকাপ এলে সেটা টের পাওয়া যায়। আশির দশক পর্যন্ত লোকাল ফুটবল নিয়েও মেতে উঠত বাংলাদেশ। সেই ফুটবল এখন বাংলাদেশের খেলাধুলার দুয়োরানি। বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই বাংলাদেশ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। সমর্থনের এই ধরনটা দেখে বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ সুন্দর ফুটবল, শৈল্পিক ফুটবলের সমঝদার দর্শক। নিছক সাফল্যের পেছনে ছোটে না বাংলাদেশ। সাফল্যই যদি সমর্থনের মাপকাঠি হতো, তাহলে চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি বা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালির সমর্থক অনেক বেশি থাকত। চোখের সামনে ফ্রান্স বা স্পেনকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে দেখলেও নতুন প্রজন্মের মানুষের মধ্যেও তাদের সমর্থক হাতেগোনা। এরা শিরোপা জিতেছে বটে তবে মানুষের হৃদয় জিততে পারেনি। ৩২ বছর আগে ম্যারাডোনা একক নৈপূণ্যে বিশ্বকাপ জিতে যে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন, সেখানে কেউ ভাগ বসাতে পারেনি। ৭০ সালের পর চতুর্থ শিরোপার জন্য ব্রাজিলকে ২৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাথে অপেক্ষা করেছে তাদের সমর্থকরাও। ব্রাজিল সমর্থকদের ২৪ বছর আর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ৩২ বছরের অসমাপ্ত অপেক্ষা দেখে বোঝা যায় তারা সাফল্যের পূজারী নয়।
১৯৩০ সালে শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপ। এবার চলছে ২১তম আসর। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিশ্বকাপে মহাতারকা আছেন মাত্র দুজন- তিনবারের বিশ্বকাপ জয়ী পেলে আর প্রায় একাই দলকে বিশ্বকাপ জেতানো ম্যারাডোনা। খেলা, খেলার বাইরে জীবনজুড়ে বিতর্কের সাথে বসবাস হলেও মানুষের ভালোবাসা পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি ম্যারডোনার। এই এত বছর পরও আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় তারকা তিনিই। এই দুই মহাতারকার বাইরে বিশ্বকাপে তারকা আছেন অনেকেই- জিকো, রোনালদো, রোমারিও, রোনালদিনহো, রসি, ব্যাজিও, বাতিস্তুতা, খুলিত, বাস্তেন, লিনেকার, বেকেনবাওয়ার, মুলার, ক্লোসা, জিদান, ইউসেবিও, ফিগো, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, প্লাতিনি, ভালদারামা, রাজার মিলা, জর্জ হ্যাজি; তালিকতা অনেক লম্বা। আরো অনেকের নামও তাতে যোগ করা যাবে। তাদের কেউ কেউ বিশ্বকাপও জিতেছেন। কিন্তু কেউই মহাতারকা হতে পারেননি।
ফুটবলের যুগস্রষ্টা পেলে আর ম্যারাডোনা। সেই তালিকায় নাম লেখানোর সুযোগ আছে আর একজনের সামনেই; তিনি লিওনেল মেসি। অবশ্য মেসির নাম বললে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর নামও বলতে হবে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই দুজন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে বিশ্ব ফুটবল মাতাচ্ছেন। দুজনই পাঁচবার করে বিশ্বের সেরা ফুটবলারের সম্মান জিতেছেন। ক্লাবের হয়ে যা যা শিরোপা জেতা সম্ভব, সবই জিতে বসে আছেন। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে তাদের শোকেস প্রায় শূন্য। প্রায় বললাম, কারণ রোনালদো দলকে ২০১৬ সালে ইউরো জিতিয়েছেন। মেসিরটা একেবারেই শূন্য। মেসি দলকে একবার বিশ্বকাপ এবং দুইবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে তুললেও শিরোপা ছুঁতে পারেননি। শেষ বার কোপায় ব্যর্থতার পর অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে আবার ফিরেও এসেছেন। মেসি এবার নেমেছেন চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলতে। এটাই তার শেষ সুযোগ। শেষ সুযোগ রোনালদোর জন্যও। তাঁরও চতুর্থ বিশ্বকাপ এটি। প্রথম ম্যাচ শেষে অবশ্য রোনালদো এগিয়ে। একক নৈপূণ্যে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক দিয়ে ঠেকিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপ জেতা স্পেনকে। পাশাপাশি প্রথম ম্যাচে মেসি অনেক নিষ্প্রভ। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিলেই খেলা ভুলে যান, এই বদনাম এবারও মেসির সঙ্গী। প্রথম ম্যাচে পেনাল্টি মিস করে আলোচনায় এসেছেন। তার দলও ড্র করেছে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসা পুচকে আইসল্যান্ডের কাছে।
বছর দুয়েক ধরে ক্লাব ফুটবলে মেসি-রোনালদোর পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে ব্রাজিলের নেইমারের নামও। বলা হচ্ছে মেসি-রোনালদো যুগ শেষ হলে বিশ্ব শাসন করবেন নেইমার। বরাবরের মতো এবারও নেইমারের ব্রাজিল হট ফেবারিট। তবে নেইমারের যা বয়স তাতে তিনি বিশ্বকাপ জেতার আরো সুযোগ পাবেন। কিন্তু মেসি আর রোনালদোর এবার সত্যিই শেষ সুযোগ। বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন হলেও পর্তুগাল বিশ্ব ফুটবলের বড় নাম নয়। আর কে না জানে বিশ্বকাপ শুধু পারফারম্যান্স দিয়ে জেতা যায় না; ইতিহাস লাগে, ঐতিহ্য লাগে। তাই শিরোপা জিততে হলে রোনালদোকে ম্যারাডোনা হতে হবে। প্রথম ম্যাচে যা দেখিয়েছেন, সেই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে রোনালদোর হাত ধরে রচিত হতে পারে ইতিহাস। ক্লাব ফুটবলে আপনি যত গ্রেটই হোন, বিশ্বকাপ না জিতলে আপনার গ্রেটনেস স্বীকৃতি পাবে না।
একই কথা প্রযোজ্য মেসির ক্ষেত্রেও। রোনালদোর মতো নেইমারও ক্লাবে ভিনগ্রহের ফুটবল খেলছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে না পারলে তাঁর গ্রেটনেস টেকসই হবে না। মানুষ ভুলে যাবে। জর্জ বেস্ট যেমন বিশ্বকাপ না খেলা সেরা খেলোয়াড়। বিশ্বকাপ না জিতলে হয়তো ভবিষ্যতে মেসি-রোনালদোর নাম উচ্চারিত হবে বিশ্বকাপ না জেতা সেরা খেলোড়ের তালিকায়। এই তালিকায় আরো অনেকের নাম আছে। আবার এই দুজনের যেই হোন, বিশ্বকাপ জিততে পারলে তাদের নাম উচ্চারিত হবে পেলে-ম্যারাডোনার সাথে। আগেই বলেছি পর্তুগাল বলে রোনালদোর সম্ভাবনা কম। তবে মেসির সম্ভাবনা আছে। যদিও দল হিসেবে এবার আর্জেন্টিনা ফেবারিট তালিকায় নেই। বাদ পড়তে পড়তে কোনোরকমে বিশ্বকাপে এসেছে। তবুও ফেবারিটরা সবসময় বিশ্বকাপ জেতে না। এমন হলেও ব্রাজিলের শিরোপা আরো বেশি হতো। ব্রাজিলই একমাত্র দল, যারা প্রতিটি বিশ্বকাপে খেলেছে এবং প্রতিবারই তাদের নাম ফেবারিটের তালিকায় ছিল। দল যেমনই হোক, আর্জেন্টিনাকে আপনি কখনো ফেবারিটের তালিকার বাইরে রাখতে পারবেন না। আর যে দলে মেসি থাকে, সেই দলের সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। বলা হয় বার্সেলোনায় মেসি যেই সহায়তাটা পান, জাতীয় দলে সেটা পান না। তবে একবার না একবার জাতীয় দলের হয়ে জ্বলে উঠতে পারেন তিনি। এবারই সেটা হোক।
মেসি-রোনালদো যে মানের খেলোয়াড়, তাদের হাতে একটা বিশ্বকাপ না হলে সেটা প্রকৃতির অবিচার হয়। আমি যেহেতু ল্যাতিন ঘরানার সমর্থক। তাই চাই এবারের বিশ্বকাপটি লিওনেল মেসির হাতেই উঠুক।
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ