কাপ যুদ্ধ
মেসি ম্যাজিশিয়ান নাকি জয়ের মিউজিক কম্পোজার
ফুটবল গ্রহে মঙ্গলবার রাতে কোনো গ্রহণ লাগেনি। বিড়ালের জ্যোতিষচর্চাও সঠিক হয়নি। সেন্ট পিটার্সবার্গে আবার আর্জেন্টিনীয় ফুটবলের বিপ্লবও ঘটেনি। কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সেটা দেখেছে গোটা ফুটবল বিশ্ব। নায়ককে জড়িয়ে মহানায়কের আবেগের যে প্রকাশ, তার ঢেউ ছিটকে পড়ল গোটা গ্যালারিতে। আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে জড়িয়ে গ্যালারিতে থাকা মানুষগুলোর চোখে জল! সেটা বেদনা বা বিষাদের নয়। সেটা উচ্ছ্বাসের। আনন্দের। কারণ, মেসি আর তাঁর আর্জেন্টিনা টিকে আছে বিশ্বকাপে। মেসি যদি হন দলটার প্রাণভোমরা, তাহলে ওই দর্শকদের ভালোবাসা আর আবেগ হচ্ছে তাঁদের প্রাণবায়ু।
কিন্তু ম্যাচের আয়ু যখন ৮৬ মিনিট, সে সময় রোহোর দুর্দান্ত এক গোল রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, শ্বাসবন্ধ হয়ে আসা আর্জেন্টিনা দল আর তাদের সমর্থকদের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিল। তার আগ পর্যন্ত নাইজেরিয়া ম্যাচের স্কোর লাইনটা ১-১ রেখে আর্জেন্টিনার জন্য বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়ের প্রিলিউড কম্পোজ করে ফেলেছিল। কিন্ত শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে আর্জেন্টিনার বিদায়ের করুণ মিউজিকটা আর বাজেনি। সৌজন্যে রোহোর দুর্দান্ত এক গোল। ওটাই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপে টিকে থাকার ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট হয়ে গেল। আর্জেন্টিনা আর তাদের সমর্থকদের কাছে ওই গোলটা আপাতত নতুন রিং টোন হয়ে বাজতে শুরু করেছে, ‘আমরাও আছি’!
হ্যাঁ, আর্জেন্টিনা এখনো বিশ্বকাপে আছে। সেই থাকা মানে কাপ জয়ের আশা নিয়েই থাকা। কিন্তু রোহোর গোল যদি আর্জেন্টিনার জন্য ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট হয়, তাহলে তাদের দলের আসল ম্যাজিশিয়ান কোথায় ছিলেন? হ্যাঁ, তিনিও ছিলেন। ভালোমতোই ছিলেন। ম্যাজিক তো তিনিও দেখিয়েছেন। ম্যাচের ১৪ মিনিটেই এবারের বিশ্বকাপে দর্শক প্রথম দেখলেন মেসি ম্যাজিক। বক্সের বেশ বাইরে বাঁ পায়ের ঊরু দিয়ে বলটা নামালেন। বাঁ পায়ের পাতা দিয়ে সেটা সামনে রোল করালেন। তার পর ডান পায়ের অসাধারণ এক কিকে বল খুঁজে নিল নাইজেরিয়ানদের জাল। সেই চেনা মেসিকেই দেখল ফুটবল বিশ্ব। যে মেসিকে দেখতে চান পৃথিবীসুদ্ধ ফুটবল দর্শকরা। তবে আর্জেন্টিনার বাঁচা-মরার এই ম্যাচটায় মেসি ম্যাজিক যা দেখা গেল, তার চেয়ে অন্য আরেকটা বড় জিনিস তিনি দেখালেন। তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারেন। তিনিই আবার জয়মন্ত্রের মিউজিক কম্পোজও করতে পারেন। করেও দেখালে এ ম্যাচে। আগের দুটো ম্যাচে এই মেসিকে দেখা যায়নি। যিনি গোটা দলকে জয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। রোহোর গোলে সেই জয় নিশ্চিত হওয়ার পর তিনিই এক লাফে উড়ে পড়লেন রোহোর কাঁধে! গোটা দল ছুটে এলো সেই গোল উদযাপনে। আগের দুই ম্যাচে হতাশা-বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে থাকা মেসিকে এ ম্যাচ শেষে দেখা গেল আনন্দের ঝর্ণাধারায় স্নাত, উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত এক মানুষ হিসেবে।
এই মেসি, এই আর্জেন্টিনাকে দেখে মনে হবে, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে অন্য রকম এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তাঁরা। নিজেদের দুঃখ আর হতাশা বাকি পৃথিবীকে আর দেখাবেন না। তাঁদের হতাশা-দুঃখ দেখে অন্যরা আনন্দ পাক, সেটা তাঁরা চান না। তাই নিজেদের আবেগ-আনন্দ-আর উচ্ছ্বাসটাকেই তাঁরা দেখিয়ে গেলেন। আর সমর্থকদের আনন্দে ভাসিয়ে আর্জেন্টিনা নামক দলটা পৌঁছে গেল শেষ ষোলোতে। যেখানে তাঁরা প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবে ফরাসিদের। যাঁরা লেনিনের দেশে এসেছেন ফরাসি ফুটবলীয় বিপ্লবের পতাকা ওড়ানোর অভিযানে। সেই ম্যাচে কী হবে, কী হতে পারে, তা নিয়ে ফুটবল বিশ্বে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। ফুটবল পণ্ডিত থেকে বিড়াল-টিয়া পাখিরাও হয়তো জোতিষশাস্ত্রের চর্চা শুরু করবেন। তবে বাঙালির ফুটবল চর্চা হবে মেসিকে ঘিরে। কেউ তাঁকেই মনে করবেন ফুটবল ঈশ্বর। বলবেন, একজন ঈশ্বর যদি আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি গায়ে মাঠে থাকেন, তাহলে রাশানদের দেশে ফরাসি বিপ্লব হওয়া সম্ভব নয়। আবার পাল্টা যুক্তি হিসেবে হয়তো বলা হবে, ঈশ্বর তো আইসল্যান্ডের বিপক্ষেও ছিলেন! ক্রোয়েটরা তার উপস্থিতিতেই গুনে গুনে তিনখানা গোল দিয়েছে আর্জেন্টিনার জালে, তাহলে?
অতএব, ফুটবলে কোনো ঈশ্বরের ধারণা অচল। আছেন শুধু ম্যাজিশিয়ানরা। যাঁরা মাঠে জাদু দেখান। ফুটবলানুরাগীদের মুগ্ধ করে রাখেন। আর বাঙালির বেশি পছন্দ জাদুকরদের। কারণ, বাঙালি চিরকাল একক যুদ্ধজয়ের কাহিনীকে সব সময় রোমহর্ষক মনে করেছে। একজন ফুটবল চার-পাঁচজনকে ডজ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। গোল করছেন। সেটাই তাদের মনে দাগ কেটে থাকে। হৃদয়ে তার জন্য অন্য রকম একটা জায়গা বরাদ্দ রাখে। যেমন রেখেছেন পেলে-ম্যারাডোনার জন্য। বাঙালি স্মৃতির পকেটে এখনো টুকরো টুকরো পেলে-ম্যারাডোনা বয়ে বেড়ান। ফুটবলের উন্নত বিশ্ব এত আবেগ দিয়ে কোনো ফুটবলারের একক কীর্তিকে সযত্নে লালন করে না। তাঁদের কাছে ফুটবল টিম গেম। তাঁরা দলের বিপর্যয়-বিপন্নতায় কোনো একজন ত্রাতা বা উদ্ধারকর্তাকে খোঁজেন না।
বাঙালিকে নিয়ে আবার আরো একটা বড় সমস্যা আছে। তাঁরা ফুটবলে শুধু একজন ত্রাণকর্তা পেলেই খুশি থাকতে পারেন না। দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করতে হবে, তাঁকেই আবার একই সঙ্গে শিল্প আর সৃষ্টির ছোঁয়ায় ফুটবলীয় সৌন্দর্যের বাগানে ফুলও ফোটাতে হবে! বাঙালির কাছে মেসি তো সেই ফুল ফোটানো ত্রাণকর্তা! তিনি মানুষ সেটা ভাবতেই নারাজ ভক্তরা। বিশ্বকাপ জিততে না পারলেই বলা হবে, মেসি কী এমন বড় ফুটবলার, বিশ্বকাপ-ই তো জিততে পারলেন না!
আর এই কথাগুলো বলার সময় তাঁরা ভুলে যাবেন, ফুটবল একটা খেলা। আর খেলা মানেই শুধু ট্রফি নয়। সব সময় ট্রফিতে পালিশ করা মানেই শুধু বড় ফুটবলার নন। এখানে ধুলো-কাদা-জল-ঘাম-রক্ত অনেক কিছু আছে। এখানে কখনো আপনি পড়ে যাবেন, আবার উঠে দাঁড়াবেন। কখনো কাপ হারানোর দুঃখে ডুবে যাবেন। সেখান থেকেই হয়তো ভেসে উঠবেন। হয়তো আবার কাপটা হাতে নিয়েই হাসবেন। বিশ্বকাপ জিততে না পারলেই কি মেসি নামক ফুটবলারের পুরো ক্যারিয়ারে গ্রহণ লেগে যাবে? তাঁর সাফল্যের সব কিছু ঢাকা পড়ে যাবে? তাঁর সব কীর্তির গায়ে ব্যর্থতার কালি লেগে যাবে? না।
তবে হ্যাঁ, শুধু আর্জেন্টাইনরা কেন, পৃথিবীর বহু মানুষ আপাতত আর্জেন্টিনার ফুটবলের ভরসাস্থল ভাবছেন মেসিকে। আর সেই অন্তহীন চাপ সামলানোর জন্য তাঁকেও বোধ হয় খুঁজতে হচ্ছে ভরসার উৎসমুখ। তার নাম ঈশ্বর। যে কারণে ম্যাচ শেষে আর্জেন্টাইনদের ফুটবল ঈশ্বরের মুখ থেকে বেরিয়েছে, ‘জানতাম, ঈশ্বর আমাদের সঙ্গেই আছেন।’ মেসির ভরসা ঈশ্বর। আর্জেন্টাইনদের ভরসা মেসি। আর সেই মেসিকে ঘিরে হতাশা দূরে হলেও বিশ্বকাপটা এখনো দূরেই দেখছে আর্জেন্টিনা ভক্তরা। তা নাইজেরিয়ার বিপক্ষে যতই তাঁদের ত্রাতার নাম হোক রোহো!
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।